টাকা, তোমার উৎস কোথায়? (মান্দায় এক পল্লী চিকিৎসক হঠাৎ কোটিপতি)

নওগাঁর মান্দা উপজেলার প্রত্যন্ত পল্লীতে এক পল্লীচিকিৎসক রহস্যজনকভাবে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছেন। এর মধ্যে প্রথমজনকে (কবিরাজ) পুলিশ গ্রেফতার করেছে এবং দ্বিতীয়জনের বিরুদ্ধে এলাকাবাসী জেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছে।
নওগাঁর মান্দা উপজেলার এক ‘হঠাৎ কোটিপতি’ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর তার সম্পর্কে নানা কাহিনী শোনা যাচ্ছে। সামান্য একজন গ্রাম্য কবিরাজ থেকে অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া এ ব্যক্তির নাম চিত্তরঞ্জন প্রামাণিক।
যেভাবে তার গ্রামে যাওয়া : নওগাঁ বালুডাঙ্গা কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে মান্দা উপজেলার ছোট চকচম্পক গ্রাম। প্রধান সড়ক থেকে আর একটি পাকা রাস্তা এঁকেবেঁকে চলে গেছে গ্রামের ভেতর। বাঁয়ে মোড় ঘুরে সামান্য এগোতেই চোখে পড়ল চোখ ধাঁধানো সারি সারি অট্টালিকা। ডান পাশে পরপর তিনটি আলীশান বাড়ি। সব ক’টিই তিনতলা। বাম পাশে পরপর আরো দু’টি বিল্ডিং। এগুলোও তিনতলা। একটির নিচের তলায় বিশাল গরুর খামার। ওপরে স্টোর। অন্যটিও স্টোর। সবগুলোর মেঝে ও চার দেয়াল মোজাইক করা। একটির পাশে নির্মিত হচ্ছে সুইমিং পুল। বাড়ির সামনে অনেক লোকের ভিড়। কথা হলো তার চাচীর সাথে। তিনি জানালেন, ডাক্তার ১০০ বিঘার বেশি জমি করেছে। তার বাড়িতে দেখা গেল একটি অ্যাম্বুলেন্স, একটি প্রাইভেটকার ও দু’টি মাইক্রোবাস। পাঁজরভাঙা বাজারে কথা হলো স্খানীয় সরকারি দলের নেতা ফজলুর রহমানের সাথে। তিনি জানালেন, বর্তমানে ডাক্তারের নগদ টাকার পরিমাণ আড়াই শ’ কোটি টাকার ওপর।
ডাক্তারের বাড়ির কাছেই দেখা হলো ডিবি পুলিশের ইন্সপেক্টর আতাউর রহমানের সাথে। আশপাশে বিভিন্ন জনের সাথে কথা বলে জানা গেল, এক এনজিও কর্মী ডাক্তারের বিরুদ্ধে মান্দা থানায় মৌখিক অভিযোগ দিলে পুলিশ ৩১ মে ডাক্তার চিত্তরঞ্জন ও তার ছেলে নিত্যগোপালকে থানায় নিয়ে যায়।
পরে মান্দা থানা পুলিশের এসআই খলিলুর রহমান বাদি হয়ে ডাক্তারের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৬, ৪২০, ৪৬৭, ৪৬৮, ৪৭১ ধারায় থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় অভিযোগ করা হয়, ডাক্তার নবম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করলেও সাইনবোর্ডে তার নামের আগে ডা. এবং পরে ডিডিআরএমপি লেখেন। অথচ তিনি সেসবের কোনো সার্টিফিকেট দেখাতে পারেননি। তিনি ডাক্তার না হয়েও দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা সেবার নামে প্রতারণা করে আসছেন।
ডাক্তার চিত্তরঞ্জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ কোর্টে চালান দিলে আদালত তাকে জেলহাজতে পাঠান। তাকে গ্রেফতারের দিন থেকেই তার গ্রামের লোকেরা বিক্ষোভ করতে থাকে। প্রতিদিন শত শত মানুষ তার বাড়ির সামনে ভিড় জমায়। বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশ তাদের গ্রেফতারের ভয় দেখায়। কয়েকজনকে মারধরও করে। পুলিশ ভ্যান প্রায়ই তার বাড়ির সামনে দিয়ে টহল দিচ্ছে। সাদা পোশাকে ডিবি পুলিশ ২৪ ঘন্টা ডিউটি করছে।
অসাধারণ জনপ্রিয়তা : ডাক্তারের বাড়ির সামনে উপস্খিত কয়েকজনের সাথে আলাপ করলে তারা জানান, এলাকায় ডাক্তার খুবই জনপ্রিয়। তিনি সারাবছর বাকিতে রোগী দেখেন এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ দেন। প্রয়োজন হলে রোগীকে নিজের অ্যাম্বুলেন্সে করে রাজশাহী-ঢাকা নিয়ে যান। নিজের খরচে অপারেশন করান। কারো মেয়ের বিয়েতে ডাক্তার ১০-২০ হাজার টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেন। আশপাশের ১০০ গ্রামের মানুষের কাছে তিনি দেবতা। তাই তারা তার প্রাসাদের নাম দিয়েছেন ‘দেবতার প্রতিষ্ঠান’। তারা মনে করেন, তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে অন্যায়ভাবে। সবাই চান তাড়াতাড়ি তার মুক্তি হোক।
অদ্ভুত সুদের কারবার : ডাক্তারের রয়েছে অদ্ভুদ সুদের কারবার। তিনি কারও কাছ থেকে সুদ নেন না, বরং দেন। তার কাছ থেকে গত ১০ বছরে সুদের কারবার করে ১ হাজার টাকার পুঁজি থেকে ১ লাখ টাকার মালিক হয়েছেন এমন লোকের সংখ্যা অনেক। ডাক্তার মানুষের কাছ থেকে প্রথম দিকে ১ লাখ টাকা নিয়ে মাসে সুদ দিতেন ১০ হাজার টাকা। এখন দেন মাসে ৩ হাজার টাকা। সময়মতো সুদ-আসল পরিশোধে তার খ্যাতি রয়েছে। গত ১০ বছরের হিসাবে এক টাকাও কম পায়নি কেউ। আশপাশের কয়েক জেলার লোক তার কাছে টাকা লগ্নি করেছে। সংখ্যায় কয়েক হাজার। আর লগ্নির পরিমাণ কয়েক শ’ কোটি টাকা।
এসব তথ্য দিয়েছেন তার এক কর্মচারী নাজিম উদ্দিন। টাকা লগ্নি আর সুদের হিসাব করা ও বিতরণের জন্য তার রয়েছে ৬৯ জন কর্মচারী। ডাক্তার ও তার ছেলের নামে রেজিস্ট্রেশন করা ছোট চকচম্পক সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতি লি. নামে একটি এনজিওর মাধ্যমে এসব লেনদেন করা হয়।
এলাকাবাসী জানান, সারা বছর বাকিতে রোগী দেখে বছর শেষে ধান উঠলে ডাক্তার হালখাতার আয়োজন করেন। সুদে-আসলে তখন সব টাকা পরিশোধ করতে হয়। হালখাতায় ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকা আদায় হয়। তার কর্মচারীরা জানান, যারা ডাক্তারের কাছে টাকা লগ্নি করেন তাদেরকে কোনো দলিল দেন না, শুধু তার ডাক্তারি প্যাডে টাকার অঙ্ক লিখে দেন। এভাবে একজন ৫০ লাখ টাকা এবং একটি দল ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত দিয়েছে। সবার সুদও দেয়া হয় শুধু ডাক্তারের কাছে রক্ষিত খাতার হিসাবে। এজন্য লগ্নিকারীদের কোনো পাস বইও দেয়া হয় না। এলাকাবাসী জানান, ১০ বছর আগেও চিত্তরঞ্জন হাটে হাটে পুঁটলিতে করে এলোপ্যাথি ওষুধ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এই ক’বছরে বিপুল বৈভবের মালিক হয়েছেন।
অলৌকিক ব্যাখ্যা : ডাক্তার সম্পর্কে তার স্ত্রী দিপালী রানী দিলেন অলৌকিক ব্যাখ্যা। তিনি বলেন, তার সাথে বিয়ের আগে থেকে সাপ আছে। বিয়ের পর তা তার সাথে এসেছে। সে-ই তাকে অঢেল টাকা দিয়েছে।
যে প্রশ্ন কেউ তোলেনি : ডাক্তার প্রতি মাসে সুদ বাবদ বিতরণ করেন প্রায় ২ কোটি টাকা। কেউ কখনো কম পায়নি। কারো টাকা তিনি বাকিও রাখেননি। এত টাকা সুদ তিনি দেন কোথেকে এবং টাকা নিয়ে কী কাজে লাগান তা কেউ জানে না। নিয়মিত সুদের টাকা পাওয়ায় কেউই তাকে এ প্রশ্ন করেনি। তার ব্যবসাটা যে কী, সে অভিযোগ তোলেনি পুলিশও।
নওগাঁর সদর, আত্রাই, মান্দা, নিয়ামতপুর, রানীনগর, মহাদেবপুর, রাজশাহীর বাগমারা, তানোরসহ কয়েকটি উপজেলার পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ তার কাছে টাকা রেখেছেন। প্রতিদিন তারা তার বাড়ির সামনে এসে তার খোঁজ নিচ্ছেন। তাদের ধারণা, ডাক্তারের জামিন না হলে তারা সুদ বা আসল কিছুই পাবেন না। এ জন্য তারা সহজে সাংবাদিকদের কিছু বলছেন না। মোটা টাকা লাগানো একটি গ্রুপের ২০-২৫ জন ক্যাডার তার বাড়ির বিভিন্ন স্খানে ২৪ ঘন্টা অবস্খান করছে, যেন তার স্ত্রী-কন্যা পালিয়ে যেতে না পারে।
ছেলে কোথায় : মামলা হয়েছে পিতা-পুত্র দু’জনের বিরুদ্ধে। জনতা বলছে, পুলিশ দু’জনকেই গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। কিন্তু সেদিন থেকেই পুত্রের আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তদন্তকারী কর্মকর্তা জানালেন তারা শুধু ডাক্তারকে ধরেছেন। একটি সূত্র জানায়, পুলিশ তাকে ক্লিনিক ও ডাক্তারি সনদ এবং হয়তো আরো কিছু আনার জন্য ছেড়ে দেয়। কিন্তু ছাড়া পেয়ে সে পালিয়ে যায়।

সূএঃ নয়া দিগন্ত

Popular posts from this blog

“নওগাঁয় মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা”

নওগাঁয় পূর্বের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে,মেলায় অবৈধ ব্যাবসা

দূর্নীতি ছেয়ে আছে নওগাঁ বিটিআরএ