জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম স্থবির

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়েছে। চাহিদা থাকা সত্ত্বেও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণসামগ্রীর সরবরাহ না থাকায় আগ্রহী দম্পতি সেবা পাচ্ছে না। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাঠকর্মীরা আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে আগের মতো সেবা দিচ্ছেন না। প্রচারও দুর্বল হয়ে পড়েছে।
সরকারের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, মাঠপর্যায়ে পর্যাপ্ত জনবল নেই বলে সেবা পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে না। মন্ত্রণালয় বলছে, ক্যাডার নন-ক্যাডার দ্বন্দ্বে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ-পদোন্নতি বন্ধ রয়েছে। ক্রয়ে দুর্নীতি এবং নিয়োগ-পদোন্নতিতে অনিয়মের কারণে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের এই বেহাল পরিস্থিতি বলে মন্তব্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।
চাহিদা আছে, সরবরাহ নেই: পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০০৫ সাল থেকে জন্ননিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ও সামগ্রীর (ইনজেকটেবল, কনডম, আইইউডি ও ইমপ্লান্ট) নিয়মিত সরবরাহ নেই। গত ১২ মে প্রকাশিত স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা খাত কর্মসুচির বার্ষিক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুই বছর ধরে আইইউডি (ইনট্রাইউট্রাইন ডিভাইস। এটি মহিলাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি অস্থায়ী পদ্ধতি, এটি জরায়ুতে স্থাপন করা হয়) এবং এক বছর ধরে ইমপ্লান্ট (মহিলাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি অস্থায়ী পদ্ধতি। দিয়াশলাইয়ের কাঠির চেয়ে ছোট ছোট ছয়টি ক্যাপসুল, মহিলাদের কনুইয়ের ওপরে ভেতরের দিকে চামড়ার নিচে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়)-এর সরবরাহ বন্ধ আছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর্মসুচি ঝিমিয়ে পড়ার এটি বড় কারণ।
অন্যদিকে সর্বশেষ বাংলাদেশ জনসংখ্যা ও স্বাস্থ্য জরিপে বলা হচ্ছে, চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ১৭ শতাংশ আগ্রহী মানুষের কাছে জন্ননিয়ন্ত্রণ সেবা পৌঁছাচ্ছে না। দিন দিন অপূরণীয় চাহিদার হার বাড়ছে। ২০০৪ সালের জরিপে এই হার ছিল ১৪ শতাংশ।
অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্বব্যাংকের নির্দেশিকা মেনে জন্ননিয়ন্ত্রণ পণ্যসামগ্রী কিনতে ৬৫টি স্বাক্ষর প্রয়োজন হয়। তিনটি স্বাক্ষর আনতে হয় যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন থেকে। এতে ১৮ মাস সময় লেগে যায়। জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক (গবেষণা) আহমেদ আল-সাবির বলেন, ক্রয়ের ক্ষেত্রে এই দীর্ঘসুত্রতা দুর করতে না পারলে জন্ননিয়ন্ত্রণসামগ্রী সহজলভ্য করা যাবে না।
ডিডিএস কিট নেই: অনিয়মের কারণে মাঠপর্যায়ে এখন আর ডিডিএস কিটের (২৩ ধরনের ওষুধ ও জরুরি চিকিৎসাসামগ্রীর বাক্স) সরবরাহ নেই। অধিদপ্তর সুত্র বলছে, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণকেন্দ্রে ব্যবহারের জন্য প্রতি মাসে সারা দেশে ১০ হাজার ৫৫১টি ডিডিএস কিট দরকার। বর্তমানে দেশের কোথাও ডিডিএস কিট নেই। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (লজিস্টিক) হোসেন মোল্লা জানালেন, নতুন ডিডিএস কিট কেনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সুত্র বলছে, জোট সরকারের আমলে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশে একবারে প্রয়োজনের দ্বিগুণ ডিডিএস কিট কেনা হয়েছিল। কিন্তু মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে দেখে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিট কেন্দ্রগুলোতে পাঠানো হয়। মাঠপর্যায়ে তা ব্যবহার করা যায়নি।
অধিদপ্তর সুত্রে পাওয়া কাগজপত্রে দেখা যায়, মার্চে ডিডিএস কিটের মজুদ শেষ হয়েছে। দীর্ঘ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এই কিট কিনে মাঠপর্যায়ে পাঠাতে দেড় বছর লাগবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সের শিক্ষক এ কে এম নুর-উন-নবী বলেন, এখন মাঠকর্মীরা চাইলেও মানুষকে সেবা দিতে পারবেন না। দীর্ঘ সময় ধরে এ অবস্থা চলতে থাকলে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে জনসংখ্যার ওপর।
বাড়ি পরিদর্শন কমে গেছে: এ বছরের মার্চে প্রকাশিত সর্বশেষ বাংলাদেশ জনসংখ্যা ও স্বাস্থ্য জরিপ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৭৯ শতাংশ বিবাহিত মহিলার কাছে পরিবার পরিকল্পনার মাঠকর্মী সেবা নিয়ে যান না। মাঠকর্মীরা মাত্র ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ মহিলাকে বাড়িতে গিয়ে সেবা দেন। বাকিরা সেবা পান স্বাস্থ্যকর্মী ও এনজিওকর্মীর কাছ থেকে।
বাংলাদেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সফল হওয়ার একটি বড় কারণ ছিল পরিবার পরিকল্পনার মাঠকর্মীদের নিয়মিত বাড়ি পরিদর্শন। জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের (নিপোর্ট) পরিচালক (গবেষণা) আহমেদ আল-সাবির বলেন, এসব মাঠকর্মী সক্ষম দম্পতিকে জন্ননিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি জন্ননিয়ন্ত্রণসামগ্রী বিতরণ করেন। কিন্তু ক্রমান্বয়ে বাড়ি পরিদর্শন কমে আসছে। নিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৩-৯৪ সালে মাঠকর্মীরা ৪৩ শতাংশ বাড়ি পরিদর্শন করতেন। ১৯৯৭-৯৮ সালে তা কমে ৩৫ শতাংশে এবং ১৯৯৯-২০০০ সালে ১৮ শতাংশে দাঁড়ায়।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুম বলেন, বাড়ি পরিদর্শন কমে যাওয়ার একটি কারণ মাঠকর্মীর স্বল্পতা। সত্তরের দশকে বা আশির দশকের তুলনায় প্রতিটি এলাকায় পরিবারের সংখ্যা বেড়েছে। একজন মাঠকর্মীকে আগের চেয়ে বেশি পরিবার পরিদর্শন করতে হয়। তিনি জানালেন, শুন্যপদ পূরণের পাশাপাশি বাড়তি লোক নিয়োগের বিষয়টি সরকার বিবেচনা করছে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের একটি সাম্প্রতিক দলিলে দেখা যায়, ৫২ হাজার ১২২ মাঠকর্মীর পদের মধ্যে সাত হাজার ৩৭৩টি পদ (১৪ দশমিক ১৪ শতাংশ) খালি আছে।
প্রচার নেই: পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (আইইএম) গণেশ চন্দ্র সরকার বলেন, প্রচার-প্রচারণা সত্তর বা আশির দশকের তুলনায় কম হচ্ছে। যা হচ্ছে তারও যথাযথ মূলায়ন হওয়া দরকার।
আহমেদ আল-সাবির বলেন, নতুন দম্পতিকে পরিবার পরিকল্পনার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধকরণ, জন্ননিয়ন্ত্রণের নতুন পদ্ধতি সম্পর্কে তথ্য প্রদান−এসব ক্ষেত্রে যোগাযোগের ধরন পরিবর্তন (বিহেবিয়ার চেঞ্জ কমিউনিকেশন) হওয়া দরকার।
সরকারি জরিপ বলছে, পরিবার পরিকল্পনার বার্তা টেলিভিশনের মাধ্যমে আগের চেয়ে বেশিসংখ্যক বিবাহিত মহিলা পাচ্ছে। কিন্তু রেডিওর মাধ্যমে বার্তা পাচ্ছে এমন মহিলার সংখ্যা কমছে। ১৯৯৩-০৪ সালে ৪২ শতাংশ বিবাহিত মহিলা রেডিওর মাধ্যমে বার্তা পেত। ১৯৯৯-২০০০ সালে তা কমে ২৫ শতাংশে এসে দাঁড়ায়। আর ২০০৭ সালে তা ১৩ শতাংশে পৌঁছায়।
সংশ্লিষ্ট একটি সুত্র বলছে, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর টেলিভিশনের চেয়ে রেডিওর অনুষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ বেশি রেখেছে। কিন্তু বর্তমানে রেডিওর চেয়ে টেলিভিশনের মাধ্যমেই বেশিসংখ্যক বিবাহিত মহিলা পরিবার পরিকল্পনা বা জন্ননিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পারছে।
এ ব্যাপারে গণেশ চন্দ্র সরকার বলেন, টেলিভিশনে প্রচারের ওপর এখন বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন ছাড়াও বেসরকারি চ্যানেলে পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যাপারে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে।

নষ্ট সুখী বড়ি: বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতির যেসব খাত চিহ্নিত করেছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল ক্রয় খাত। জন্ননিয়ন্ত্রণসামগ্রী কেনার ক্ষেত্রেও নানা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অস্থায়ী জন্ননিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় মুখে খাওয়ার বড়ি। অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতি মাসে ৮৬ লাখ ৬৩ হাজারের বেশি বড়ি দেশের মহিলারা ব্যবহার করে।
২০০৭ সালের ৪ নভেম্বর শাহ আলম (আঞ্চলিক সরবরাহ কর্মকর্তা, আঞ্চলিক পণ্যাগার, পরিবার পরিকল্পনা, আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালককে (উপকরণ ও সরবরাহ) লেখা চিঠিতে জানান, পটিয়ার উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের গুদামে নিম্নমানের সাত হাজার ৩৪৭ পাতা খাবার বড়ি ‘সুখী’ পাওয়া যায়।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের পরিচালক রেহানা বেগম গত বছরের ১৮ মে মহাপরিচালককে লেখা চিঠিতে জানান, ওই কেন্দ্রে সরবরাহ করা সুখী বড়ির প্রতিটি প্যাকেটের কিছু বড়ি নষ্ট। এ কারণে কেন্দ্রে আসা মহিলাদের সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। সুখী খাবার বড়ি সম্পর্কে একই অভিযোগ আসে নোয়াখালী থেকেও।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জন্ননিয়ন্ত্রণসামগ্রীর ওপর আস্থা থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মহিলারা যদি খাবার বড়ি বা পুরুষ যদি কনডমের ওপর আস্থা রাখতে না পারে, তাহলে কর্মসুচি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

প্রশাসনে হ য ব র ল অবস্থা: প্রশাসন ক্যাডারের আধিপত্য পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমকে পঙ্গু করে ফেলছে, এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্ট অনেকেরই। অধিদপ্তরে নয়টি পরিচালকের পদের মধ্যে সাতটিতে প্রশাসন ক্যাডারের ও দুটিতে চিকিৎসক ক্যাডারের লোক বসানো হয়েছে। ছয়টি বিভাগের ছয়টি পরিচালকের পদেও প্রশাসন ক্যাডারের লোক বসানো হয়েছে। এ ছাড়া মহাপরিচালকও প্রশাসন ক্যাডারের। এসব পদে পরিবার পরিকল্পনা ক্যাডারের যোগ্য লোক থাকলেও তাঁদের নিয়োগ-পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে না।
৩০ বছর চাকরি করে অতিসম্প্রতি অবসরকালীন ছুটিতে যাওয়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, মূলত যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে জন্ননিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের এই বেহাল দশা।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের অধীন ৪৬৪ কর্মকর্তার পদের মধ্যে ২৩০টি বিসিএস ক্যাডারভুক্ত। যে ২৩৪টি পদ ক্যাডারভুক্ত করা হয়নি, তারা পদ সৃষ্টির পর থেকে ক্যাডারভুক্ত হতে আন্দোলন করছে। সহকারী পরিচালকের ৮০টি পদ ক্যাডারভুক্ত ছিল। কিন্তু ২০০৩ সালে ৬৪টি পদ নন-ক্যাডার ঘোষণা করা হয়। অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রেষণে ৫৫ জন চিকিৎসক গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে আছেন। ১৮ বছর আগে থেকে এই জটিলতার শুরু।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের শিক্ষক এ কে এম নুর-উন-নবী বলেন, প্রশাসনের যেকোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা কর্মসুচির জন্য ক্ষতিকর। তিনি মনে করেন, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে, তাঁদেরই নেতৃত্ব দিতে হবে।

সূত্র: প্রথম আলো

Popular posts from this blog

“নওগাঁয় মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা”

নওগাঁয় পূর্বের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে,মেলায় অবৈধ ব্যাবসা

দূর্নীতি ছেয়ে আছে নওগাঁ বিটিআরএ