এক জন মুক্তিযুদ্ধা জলিলের সাক্ষাৎকার (পর্ব ৪র্থ)

প্র : আপনি যেদিন আবার ফিরে আসলেন নওগাঁ-তে সেটা কয় তারিখ। নওগাঁ থেকে টাকা নিয়ে গেলেন, ওখানে রাখলেন, তারপরে আবার আসলেন কবে?



উ : ২২ এপ্রিল তারিখে হবে। নওগাঁ যাওয়ার পথে দেখি যে, আমাদের ছেলেপেলে যারা নওগাঁয় ছিলো তারা সব ইণ্ডিয়ার দিকে যাচ্ছে। আমি তাদের বলি, কি হলো! তোমরা ব্যাক করছ কেন? তারা বললো যে, পাকিস্তান আর্মি নওগাঁতে ঢুকে গেছে। আমি বললাম যে, না, আমি এটা বিশ্বাস করি না। তোমরা চলো আমার সঙ্গে। তখন ঐ যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়া মোজাম্মেল হক, সে আমাকে বললো যে, সত্যি পাক আর্মি নওগাঁতে ঢুকে গেছে। ওরা কিছু মান্দা দিয়ে ঢুকেছে আর কিছু বগুড়া থেকে আসছে। সুতরাং তুমি আর ইন করতে পারবে না। এ অবস্থায় আমি বললাম যে, ঠিক আছে, তাহলে তোমরা সবাই চলো আমার সাথে। তারপরে ওদের সবাইকে নিয়ে আমি আবার বালুরঘাটে চলে আসলাম।



বালুরঘাটে গিয়ে আমি প্রথমে কংগ্রেস অফিসে গেলাম। ওখানে গিয়ে তাদের বললাম, আমাদের একটা বাড়ি আর একটা জায়গা দেন। ভাড়া নেবো। কারণ এই ছেলেগুলো এদিক ওদিক চলে গেলে আমি পরে আর এদেরকে পাবো না। এরা বিভিন্ন জায়গায় নানা কাজে জড়ায়ে যাবে। তারা সেদিনই আমাদের জন্য দোতলা একটা বাড়ি খুঁজে দিলো। আমরা বাড়িটা ভাড়া নিলাম। ভাড়া নিয়ে দোতলায় এই সব ছেলেদের তুললাম। তুলে সকাল বেলায় ওদেরকে খাবার টাবার জোগাড় করে দিয়ে বাসায় তালা লাগিয়ে আমি বাইরে গেলাম ক্যাম্প করার জায়গা খুঁজতে।



প্র : তখন তো বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছে। এ সময় সরকারের সঙ্গে কি আপনাদের কোনো যোগাযোগ হয়েছিলো?



উ : তখন বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগই নাই। ওখানে যা করার সব আমরা নিজস্ব ভাবেই করছি। আমরা জানি মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে, হবে। এখন বাঁচার তাগিদেই আমাদের নিজেদেরকে অরগানাইজ হতে হবে। দেন উই হ্যাভ টু ফাইট। আলটিমেটলি আমরা সবাই মুক্তিযুদ্ধের মূল স্রোতধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত হবো। কিন্তু তার আগে আমাদের নিজেদের একটু গুছিয়ে নিতে হবে। এই ছিলো আমার আইডিয়া। এই আইডিয়া নিয়েই আমি ওসব করছিলাম।



প্র : বাংলাদেশ সরকার গঠনের ব্যাপারে আপনি কোনো সংবাদ পান নি?



উ : বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছে এই খবর আমি পেয়েছি। তখন সেখানে যোগাযোগ করার মতো অবস্থা আমাদের ছিলো না। যাহোক, আমি খুব কৃতজ্ঞ যে, আমার সঙ্গে যাঁরা ছিলেন, বা সংগ্রাম পরিষদের বা অন্য যারা ছিলেন তাঁরা অ্যাবস্যুলেটলি আমাকে সাপোর্ট দিয়েছেন। কোনো প্রশ্ন ছাড়াই তাঁরা আমাকে সাপোর্ট দিয়েছেন যার জন্য এই কাজগুলো করা আমার পক্ষে সহজ হয়েছিলো।



প্র : নওগাঁ এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার অন্যান্য এম.এন.এ. এবং এম.পি. যাঁরা ছিলেন তাঁরা তখন কোথায়?



উ : তাঁরা তো তাঁদের নিজ নিজ জায়গায় চলে গেছেন। তাঁদের অনেকেই বয়স্ক লোক ছিলেন। তাদের পক্ষে আমার মতো দৌড়ঝাঁপ মেরে কাজ করা সম্ভব ছিলো না। তাই তাঁরা আমাকে সাপোর্ট করেছেন। হোয়াট এভার আই অ্যাম ডুইং, দে আর গিভিং মি অল সাপোর্ট। যাহোক, আমি ইণ্ডিয়ান বর্ডারে বাঙালিপুর বলে একটা জায়গা, জায়গাটা পাঁচবিবির ঠিক অপজিটে, ওখানে গিয়ে একটা প্রাইমারি স্কুল পেলাম। ঐ প্রাইমারি স্কুলকে টাকা দেওয়া হলো। ঐ স্কুলে আমরা প্রথম ক্যাম্প তৈরি করে আমাদের ছেলেদের ঐ ক্যাম্পে শিফ্‌ট করলাম। আমাদের ক্যাম্প শুরু হলো ৭৪ জন নিয়ে।



প্র : এরা কি সবাই সশস্ত্র ছিলো?



উ : না, সবাই সশস্ত্র না। সশস্ত্র যারা ছিলো তাদের আমি আলাদা করলাম। ওখানে যারা ছিলো তারা সব ইয়ুথ। ইয়ুথদের আমি আলাদা রাখলাম। পরে ঐ প্রাইমারি স্কুলের পাশে সোবরা ক্যাম্প বলে একটা ক্যাম্প করা হয়। সেটাতে সমস্ত এক্স আর্মি, এক্স পুলিশদের রাখা হয়। এটাও ঐ বাঙালিপুরের কাছেই। বাঙালিপুর হলো বালুরঘাটে। সোবরা পশ্চিম দিনাজপুরের মধ্যে।



এদিকে আমার ফ্যামিলিকে আমি রেখে গেছি বাংলাদেশের ভিতরেই। বারেক বলে তখন আমার এক ড্রাইভার ছিলো। সে রাতে আমাকে বললো যে, ভাবীকে রেখে আসছেন তাদের নিয়ে আসা দরকার। না নিয়ে আসলে পাঞ্জাবিরা যদি খবর পায় তো ওদের ধরে অত্যাচার করবে। আমি বললাম যে, ২/১ দিন পরে আনা যাবে। পরে ওর তাগাদায় আমি গাড়ি পাঠালাম মজিদ সাহেবের শ্বশুর বাড়িতে।



সেখান থেকে আমার ফ্যামিলি আসার পথে একটা সমস্যায় পড়ে। জায়গাটা তপন থানার মধ্যে। ওখান দিয়ে আমার গাড়ি মজিদ সাহেবের শ্বশুর বাড়িতে যাবে। কিন্তু ঐ সময় ওখানের একটা গ্রামে ডাকাতি হয়। ডাকাতরা ৭/৮ জন মানুষকে মেরে ফেলে। ফলে, রাতে গাড়িটা আর মজিদ সাহেবের শ্বশুর বাড়ির দিকে নিয়ে যেতে পারে নাই। গাড়িটা রাতে ওখানকার থানায় রাখা হয়। পরদিন ভোর বেলায় বারেক গিয়ে আমার ফ্যামিলি নিয়ে চলে আসে। আমার ফ্যামিলি চলে আসার এক ঘন্টা পরই পাক আর্মি ওখানে গিয়ে হাজির হয়। তারা খবর পেয়েছিলো যে, আমার ফ্যামিলি ওখানে আছে। আর্মি গিয়ে নাকি বলে যে, আবদুল জলিলের ফ্যামিলি কোথায়? তারা বলেছেন যে, ওনার ফ্যামিলি চলে গেছে। আমার ফ্যামিলি কোথায় এটা জানার জন্য পাক আর্মি এক গ্রামবাসীকে তখন গুলি করে হত্যা করে। কিন্তু আমার ফ্যামিলি তার আগেই তো নিরাপদ জায়গায় চলে এসেছে।



যাহোক, আমি বাঙালিপুরে ৭৪ জনকে নিয়ে ক্যাম্প স্থাপন করলাম। পরবর্তীকালে ওটাই ইয়ুথ রিসেপশন ক্যাম্প এবং ইয়ুথ ট্রেনিং ক্যাম্প হয় এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বড় ক্যাম্পে রূপান্তরিত হয়। রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, নওগাঁ, জয়পুরহাট এলাকার সবাই ওখানেই রিক্রুট হতে থাকে। এরমধ্যে পারিলায় একটা ক্যাম্প স্থাপন করলাম। পরে আমরা আরেকটা ক্যাম্প করলাম পতিরাম। সেখানে প্রাথমিক ট্রেনিং দিয়ে আমরা ছেলেদের পাঠাতে থাকলাম হায়ার ট্রেনিংয়ে। হায়ার ট্রেনিং নিয়ে তারা আবার আমাদের কাছেই আসে। তারা আমাদের মাধ্যমে আমর্স নিয়ে বাংলাদেশের ভিতরে যেতে থাকে। এই কার্যক্রমের মধ্যদিয়ে আমরা ঐ এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ অরগানাইজ করেছি এবং বাই দিস টাইম ইণ্ডিয়ান অথরিটির সঙ্গেও আমাদের একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ইণ্ডিয়ান পুলিশ, বিএসএফ, আর্মি, সিভিল প্রশাসন সবাই আমাদের সব রকম সাপোর্ট করেছে।



প্র : আপনারা বাংলাদেশ থেকে যে টাকা নিয়ে গিয়েছিলেন সেই টাকার হিসাব সংরক্ষণ করেছিলেন কি?



উ : হ্যাঁ। টাকা ভারতে বসেই কাউন্ট করে ৭১ লক্ষ ৮০ হাজার হয়েছিলো। সেই টাকা স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার বালুরঘাট শাখায় একাউন্ট খুলে জমা দেয়া হয়। আমিই ঐ ব্যাংক একাউন্ট অপারেট করতাম। ওখানে একটা অফিস আমরা করেছিলাম। সেখানে খরচের হিসাব পত্র সংরক্ষণ করা হতো। একটা পূর্ণাঙ্গ অফিসে যেভাবে হিসাবপত্র রাখা হয় ঠিক সে ভাবেই ওখানে হিসাবপত্র রাখা হয়েছিলো। প্রত্যেক খরচের ভাউচার ছিলো। সেগুলো ক্যাশ বুকে এন্ট্রি দেয়া হতো। এ কাজগুলো কিছু লোক করতো।



এই হিসাবপত্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় মন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর সঙ্গে আসা অডিট টিমও পরীক্ষা করেছিলো যুদ্ধকালেই। মুক্তিযুদ্ধ শেষে ঐ হিসাবপত্র আমি বাংলাদেশ সরকারের মিনিস্ট্রি অব ফিন্যান্সে প্রদান করেছি এবং উদ্বৃত্ত টাকা ফেরত এনে ন্যাশনাল ব্যাংকের ঐ শাখায় জমা করেছি। প্রায় ৩৪ লক্ষ টাকা উদ্বৃত্ত ছিলো। মনে হয় আমিই একমাত্র ব্যক্তি যে বাংলাদেশ থেকে টাকা নিয়ে যাওয়ার পর সেই টাকা থেকে যা খরচ করা হয়েছে তার হিসাব প্রদান করেছি এবং উদ্বৃত্ত টাকা ফেরত এনেছি।



একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে এ প্রসঙ্গে আমার আরো কিছু কথা বলা দরকার। এসব কথা অপ্রিয় হলেও সত্য। আমি তখন পাবলিক রিপ্রেজেনটেটিভ ছিলাম না। ফলে, তখন কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়। আমাদের ঐ এলাকায় যারা এম. পি. এবং এম. এন. এ. ছিলেন তাদের কেউ কেউ কনসপেয়ারর্ড এগেনেস্ট মি। যেহেতু কাজের মাধ্যমে তারা আমার সাথে বেশি টিকতে পারছিলো না - সেহেতু তারা কেউ কেউ আমার কর্মকাণ্ড হজমও করতে পারছিলেন না। সুতরাং তারা বিভিন্নভাবে বাংলাদেশ সরকারের কাছে আমার ব্যাপারে অভিযোগ করেন। একদিন আবদুর রাজ্জাক আমার ওখানে গেলেন। তাঁর সাথে আমার বিস্তারিত কথাবার্তা হয়। আমাকে তিনি কেন্দ্রীয় পর্যায়ের টোটাল ডেভেলপমেন্ট সম্বন্ধে বললেন। কয়েকদিন পরে সিরাজুল আলম খানও আমার ওখানে আসলেন।



এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার একজন অফিসারকে পাঠায় আমার হিসাবপত্র দেখার জন্য। তিনি মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে সম্ভবত: চুয়াডাঙ্গার এস. ডি. ও. ছিলেন। তাকে আমি বললাম যে, আপনি হিসাব নেওয়ার কে? আমি বাংলাদেশ থেকে যে টাকা এনেছি সে টাকার হিসাব আমি বাংলাদেশ সরকারের কাছে দেবো। এখন আমার ম্যাকানিজম নানাভাবে কাজ করছে। টাকা আমি এনেছি ঠিকই। কিন্তু টাকা নিয়ে এসে তো আমি আমার কাছে রাখি নাই। ব্যাংকে রেখেছি। সেখান থেকে নিয়ে খরচ হচ্ছে। এভরি ডকুমেন্ট ইজ দেয়ার। আপনি আসছেন সেই টাকার হিসাব নিতে এবং সেই টাকা নিয়ে যেতে। এখন আমি ঐ টাকা আপনাদের দিয়ে পরে আমি আপনাদের পিছে পিছে ঘুরে বেড়াবো নাকি? হাজার হাজার ছেলেরা এখানে আসছে। পরে এদের লুক আফটার করার কে থাকবে? এই বলে তাকে আমি বিদায় করে দিলাম।



এরপর আরেকদিন আসলো আবুল কাশেম বলে একজন। তিনি পরবর্তীকালে রাজশাহী ডিভিশনের ডিভিশনাল কমিশনার হয়েছিলেন। তাকেও বললাম, আপনি দয়া করে চলে যান। উনিও চলে গেলেন। তারপরে একদিন কামরুজ্জামান সাহেব আসলেন। উনি মালদাতে এসে আমাকে ডাকলেন। আমি সেখানে গেলাম। আমাকে নিয়ে উনি সারাদিন মালদা এলাকায় ঘুরলেন। আমার টোটাল কর্মকাণ্ড সম্পর্কে উনি জানলেন। জানার পরে উনি বললেন যে, ঠিক আছে, তুই কাজ কর, অসুবিধা নাই। যারা তোর নামে বা সম্পর্কে অভিযোগ করেছে তারা তো কাজ করবে না। এরা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার জন্য তোর বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে একটা কনফিউশন সৃষ্টি করছে। এই বলে উনি চলে গেলেন।



আমার তখন দম ফেলার সময় নেই। সকালে যাই রাত বারটা একটায় ফিরি। আমি ওখানে কতগুলা কাজ করতাম। যেমন একদিকে ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা অন্য দিকে ইনডাকশন করানো। এর পাশাপাশি পুলিশ, ইপিআর-দের নিয়ে আমি একটা ক্যাম্প করেছিলাম। ওদেরকে প্রায়ই বর্ডারে ফাইট করতে পাঠাতাম। এগুলো সব আমার নিজস্ব কমাণ্ডে হতো। আমার কাছে টাকাপয়সা ছিলো, ফলে এগুলো অরগানাইজ করতে কোনো অসুবিধা হয় নাই। তারপরে ইণ্ডিয়ান আর্মি, ইণ্ডিয়ান অথরিটির সঙ্গেও আমার ভালো সম্পর্ক হয়। তারা আমার কর্মকাণ্ডে খুশি ছিলো, তারা আমাকে ব্যাক আপ করতো।



সেই সময় নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার নাকি আমাকে গ্রেফতারের নির্দেশও দিয়েছিলো। ইণ্ডিয়ান অথরিটি একদিন ডেকে বললো যে, দেখো ইউ আর সো লং ইন ইণ্ডিয়ান সয়েল নো বডি উইল অ্যারেস্ট ইউ। এটার গ্যারান্টি আমরা তোমাকে দিচ্ছি। বিকজ উই হ্যাভ সিন দ্যাট ইউ আর দ্যা অনলি পারসন ইন দিস রিজন হু ইজ ওয়ার্কিং ফর দিস লিবারেশন ওয়ার। অন্যরা হোটেলে থাকছে, খাচ্ছে, এখানে ওখানে যাচ্ছে। তারা আসলে মুক্তিযুদ্ধের সাথে যুক্ত হচ্ছে না। ফিল্ড লেবেলে মুক্তিযুদ্ধের মূল কাজটা কি? টু অরগানাইজিং ইউর ফোর্স টু ফাইট। এগুলো অন্য কেউ তো করছে না। সুতরাং আমরা জেনে শুনে তোমার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবো না। আমরা তোমার ব্যাপারে আমাদের রিপোর্ট দিয়ে দেবো। আমাকে কেন্দ্র করে যখন এসব ঘটছে তখন আর এক ঘটনা ঘটলো।



আমি একদিন সন্ধ্যার দিকে ফিরেছি। দেখি যে এক ভদ্রলোক আমার জন্য বসে আছে। আমি বললাম আপনি কে? উনি বললেন যে, আমি বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রীর পি. এস.। মানে ক্যাপ্টেন মনসুর আলি সাহেবের পি. এস.। উনি বললেন যে, মনসুর সাহেব সরকারের কাজে এসেছেন। কিন্তু তার তো কোনো থাকার জায়গা বা খাওয়ার ব্যবস্থা নাই। আমি বলি আপনি খবরটা দিয়েছেন কোথায়? আমাকে তো কোনো খবর কেউ দেই নাই। উনি বললো যে, না আপনাকে খবর আমরা দেই নাই। এম. পি. সাহেবদের কাছে খবর পাঠান হয়েছে। তাঁরা কোনো ব্যবস্থা করে নাই। তারা কোনো যোগাযোগও করে নাই। উনি বললেন, তাঁরা যে কোথায়! তাঁদের আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। আমরা বিকালে এসেছি। উনি তো সার্কিট হাউজের বারান্দায় বসে আছেন। মনসুর আলী সাহেব শেষে আমাকে আপনার কথা বললেন। বললেন যে, ওর কাছে যাও ওকে আমার কথা বলো।



আমি তাকে বললাম, ঠিক আছে, আপনি যান, আমি আসছি। আমি যখন তাঁর কাছে গেলাম তখন রাত নয়টা সাড়ে নয়টা বেজে গেছে। তার আগে ওখানকার জেলা প্রশাসকের কাছে গেলাম। ইণ্ডিয়ায় জেলা প্রশাসককে ডি. এম. বলা হয়। আমি ওনার কাছে গেলাম। গিয়ে বললাম যে, আমাদের সরকারের অর্থমন্ত্রী এসেছেন। উনি বললেন, আমরা তো কোনো ইনফরমেশন পাইনি। আমি বললাম যে, উনি সার্কিট হাউজে বসে আছেন। তাঁর সিকিউরিটি এবং থাকার জায়গা দরকার, তাঁর খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা আমি করবো। আমি যেখানে থাকতাম সেখানে বলে গেলাম খাওয়ার ব্যবস্থা করতে। ডি. এম. বললেন যে, ঠিক আছে। উনি সংশ্লিষ্টদের ডাকলেন। ডেকে বললেন, মনসুর আলী সাহেবের থাকার ব্যবস্থা করো। ঐ রুমটা তাঁকে দিয়ে দাও। আর আমাকে বললেন, আপনি এস. পি. র সঙ্গে তাঁর সিকিউরিটির ব্যাপারে কথা বলেন। আমি বললাম যে, ঠিক আছে। ওখান থেকে বের হয়ে আমি এস. পি.-র কাছে গেলাম। এস. পি. হচ্ছেন খৃষ্টান ভদ্রলোক। নাম জেমস। ওনাকে বললাম যে, বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী এসেছেন ওনার সিকিউরিটির ব্যবস্থা করতে হবে। উনি বললেন, ঠিক আছে, সব ব্যবস্থা হবে। আপনি যান।



তারপরে আমি মনসুর চাচার কাছে গিয়ে বললাম যে, চাচা আপনি আসছেন, আমাকে একটা খবর দিলে তো আমি আপনাকে প্রোটেকশন এবং গার্ড অফ অনার দিয়ে নিয়ে আসতাম। উনি বললেন যে, আমি আসছি তোর কর্মকান্ড দেখার জন্যে। তোকে খবর দিয়ে কি করে আসবো? আমি দেখবো তাঁরা কি করছে আর তুই কি করিস। আমি বললাম ঠিক আছে। রাতে তাঁর খাওয়া দাওয়ার পর আমি আমাদের ক্যাম্পে গিয়ে ট্রেনিংপ্রাপ্ত যারা ছিলো তাদের আর্মস দিয়ে পাঠিয়ে তাঁর গার্ডের ব্যবস্থা করলাম। তারপরে সকাল বেলা আবার তাঁর কাছে গেলাম। বললাম যে, আমার কি কার্যক্রম আপনি দেখতে চান? উনি বললেন যে, আমি তোমার পুরো ফিল্ড ওয়ার্ক দেখতে চাই। তুমি আমাকে দেখাও। কি করছো তুমি। তোমার বিরুদ্ধে এতো অভিযোগ কেন যাচ্ছে? আমি বললাম, ঠিক আছে চলেন।



আমি ওখানে তখন নানা ধরনের কাজ অরগানাইজ করতাম। ঐ এলাকায় বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্প যেগুলো ছিলো সেই ক্যাম্পে গিয়ে তাদের অসুবিধাগুলো দেখতাম, তাদের সাহায্য করতাম। শরণার্থী ক্যাম্পে ইয়ং ছেলেপেলে থাকলে তাদেরকে রিক্রুট করে নিয়ে এসে ট্রেনিং দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে পাঠাতাম। সারাক্ষণই নানা কর্মকান্ড নিয়ে আমি ব্যস্ত থাকতাম। তো মনসুর চাচা তিন দিন ওখানে থেকে ঘুরে ঘুরে দেখলেন সব। ওনার সাথে উনি একটা টীম নিয়ে এসেছিলেন। তাদেরকে তিনি বলেছিলেন যে, ওর খরচের অডিটগুলো করো। তিনদিন ধরে ওনারা আমার খরচ অডিট করলেন। অডিট শেষ হবার পর উনি বললেন, তোমার সমস্ত কর্মকান্ডে খুবই খুশি আমি। তুমি যে কাজ করছো, করো। যারা অভিযোগ করে তাদের তো খেয়ে দেয়ে কোনো কাজ নাই! এরা শুধু শুধু মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে।



তারপর মনসুর চাচা আমাকে বললেন যে, তুমি আমাকে শিলিগুড়ি রেখে আসো। তখন আমি নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করতাম। মনসুর চাচা যে তিনদিন ওখানে ছিলেন সে ক’দিন তিনি আমার গাড়িতেই ঘুরেছেন। আমিই গাড়ি ড্রাইভ করেছি। উনি বললেন যে, তোমার ড্রাইভ আমার খুব ভালো লেগেছে। তুমি নিজে ড্রাইভ করে আমাকে শিলিগুড়ি রেখে আসো। ওখান থেকে বাই এয়ার আমি চলে যাবো। আমি বললাম, ঠিক আছে। আমি তাঁকে নিয়ে সন্ধ্যার দিকে রওনা হবো। ঠিক সেই সময় আমার কাছে একটা খবর আসলো। সে জন্য আমি তাঁকে নিয়ে শিলিগুড়ি যেতে পারলাম না।



কারণটা হলো, আমি ২৫ জনের একটা দলকে ঐ দিনই সকাল বেলা পাঠিয়েছিলাম ফারসিপাড়ার অপজিটে বস্তাবোর বলে একটা জায়গা আছে সেখানে। ওখানে পাকিস্তানিদের একটা ক্যাম্প ছিলো। ওদেরকে পাঠানো হয়েছিলো যে, তোমরা ঐ ক্যাম্পে যেয়ে গোলাগুলি করো। ক্যাম্পটাকে ওখান থেকে উঠানোর ব্যবস্থা করো। কারণ ওরা একদম বর্ডারে ক্যাম্প করেছে। সে জন্য আমাদের ঐ এলাকায় চলাচল করতে অসুবিধা হচ্ছিলো। আমি খবর পেলাম যে, ওখানে আমি যাদের পাঠিয়েছিলাম তাদের মধ্যে চারজন ছেলে মারা গেছে। এনকাউন্টারে পাক বাহিনীর গুলিতে আমাদের চারজন ছেলে মারা গেছে।



এটা শুনে আমি মনসুর চাচাকে বললাম যে, চাচা আমি তো আপনাকে নিয়ে যেতে পারবো না। উনি বললেন, কেন? আমি বললাম, সকালে আমরা যাদেরকে যুদ্ধে পাঠিয়েছিলাম তাদের মধ্যে চারজন ছেলে মারা গেছে। তার মধ্যে একজন হচ্ছে হিন্দু আর ৩ জন হচ্ছে মুসলমান। হিন্দু যে ছেলেটা মারা গেছে সে এক বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান। আমি ঐ ছেলেটিকে এক শরণার্থী ক্যাম্প থেকে নিয়ে এসেছিলাম। ওর মার কাছে থেকে চেয়ে নিয়ে এসেছিলাম, যে আপনার ছেলেকে মুক্তিযুদ্ধে দেন। সেই ছেলে আজ মারা গেছে।



প্র : ঐ হিন্দু ছেলের কি নাম ছিলো?



উ : নাম নারায়ণ। আমি মনসুর চাচাকে বললাম যে, তার সৎকার করতে হবে আর ওর মাকে আমার সান্ত্বনা দিতে হবে। উনি বললেন, ঠিক আছে, তুমি আমাকে ভালো ড্রাইভার দাও, যে আমাকে দিয়ে আসবে।



মনসুর চাচাকে পাঠানোর ব্যবস্থা করে আমি নারায়ণের মার কাছে গেলাম। তার কাছে যাওয়ার পর সে এক করুণ অবস্থা। বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তানের মৃত্যুতে চারিদিকেই আহাজারি। তো আমি গিয়ে বললাম যে, কাকি আপনার ছেলেকে নিয়ে গেলাম সত্য, কিন্তু সে দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য তার জীবনটা দিয়ে গেলো। আপনার ছেলেকে আমি ফিরিয়ে দিতে পারলাম না। এই কথা বলতেই মহিলা কান্নায় ভেঙে পড়লো। নারায়ণের মায়ের কান্না আমি এখনও ভুলতে পারি না। আমার স্মৃতিতে এটা মাঝে মাঝেই আসে। যখন নারায়ণের মায়ের কথা মনে হয় তখন আমি নিজেই অনেক সময় কেঁদে ফেলি। কি করবো, বাস্তবতা মেনে নিতেই হলো। আমরা মুসলমান ৩ জনকে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করলাম, আর রাতে আমি শ্মশানে দাঁড়িয়ে থেকে লাশটা দাহ করলাম। পরদিন সকাল বেলা থেকে আমি আবার আমার কর্মকান্ডে নেমে গেলাম।



প্র : এটা কোন্‌ মাসের ঘটনা?



উ : এটা খুব সম্ভব সেপ্টেম্বরের দিকে হবে। মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখার পাশপাশি আমি ওখানে মুক্তিযুদ্ধের প্রচারের জন্য একটা সংবাদপত্রও বের করেছিলাম।



প্র : এটা কোন্‌ মাসের দিকে করলেন?



উ : এটা জুলাই মাসে শুরু করেছিলাম। স্বাধীনতার পরেও কিছুদিন পত্রিকাটি বের করেছিলাম। পরে বন্ধ করে দিয়েছি।



প্র : পত্রিকাটি সম্পাদনা কে করতেন?



উ : অধ্যাপক মকবুল হোসেন। উনি মারা গেছেন। তিনি নওগাঁ বি. এম. সি. কলেজের বাংলার টিচার ছিলেন। উনিই সম্পাদনা করতেন পত্রিকাটা।



প্র : এটা কি সাপ্তাহিক ছিলো না পাক্ষিক?



উ : দৈনিক। পত্রিকাটিতে ঐ এলাকার যুদ্ধের খবরাখবর, তারপরে শরণার্থীদের অবস্থা, মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি; মুক্তিযুদ্ধ কেন করছি, এ সমস্ত বিষয় থাকতো। আমরা বিভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধটাকে অরগানাইজ করেছিলাম।



প্র : পত্রিকার নাম কি ছিলো?



উ : বঙ্গবাণী। চার পৃষ্ঠার পত্রিকা ছিলো।



প্র : এই পত্রিকায় যারা লিখতেন-তাঁদের নাম কি আপনার মনে পড়ে?



উ : অনেকেই তো কাজ করতেন। এখন সবার নাম তো আর খেয়াল নাই। মকবুল সাহেব ছিলেন। নওগাঁয় একজন নাটক করতেন, উনি ছিলেন। তারপরে আতাউল হক সিদ্দিকী ছিলেন, তারপরে আরো কিছু ইয়ং ছেলেপেলে ছিলো। সবার নামগুলো এই মুহূর্তে মনে নাই। আমি সম্পাদনা পরিষদের সভাপতি এবং প্রকাশক ছিলাম। এটা বের করায় ঐ এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে ব্যাপক প্রচারণা এবং তার ফলে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বিপুল সংখ্যক মানুষকে সম্পৃক্ত করা সম্ভব হয়েছিলো।



তারপর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অনেক শিক্ষককে সাহায্য করা হয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষকরা যে প্রান্ত থেকেই আসুক না কেন, আমাদের কাছে যারাই গিয়েছে, তাদেরকেই আমরা আর্থিকভাবে সাহায্য করেছি। আমার রেকর্ড আছে। মনে হয় কয়েক হাজার শিক্ষককে আমরা আর্থিকভাবে সাহায্য করেছিলাম। কাউকে একশ, কাউকে দেড়শ’, কাউকে দুইশ’ করে টাকা দেওয়া হয়েছিলো। তখন তো একশ’ টাকা অনেক! ওনাদের জন্য সেটা অনেক ছিলো।



আমি আর একটা কাজ করেছিলাম। সেটা অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের পরে। স্বাধীনতার পরে দেশে এসে যে টাকাটা আমি নিয়ে গিয়েছিলাম মানে ৭১ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা। সেই টাকা খরচের পুরো হিসাব পত্র ভাউচার এবং ডকুমেন্টস সহ আমি বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছিলাম। আর যে টাকাটা অবশিষ্ট ছিলো সেটা আমি ফেরত দিয়েছিলাম। আমি প্রায় ৩৪ লক্ষ টাকা ফেরত এনেছিলাম। সে টাকা আবার তৎকালীন ন্যাশনাল ব্যাংকে, মানে এখনকার সোনালী ব্যাংকে আমি জমা দিয়েছিলাম। সব রিসিট আমার কাছে আছে। রিসিট নিয়েই আমি জমা দিয়েছিলাম। তখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমেদ। তাঁকে আমি একটা চিঠি লিখেছিলাম ডেয়ার মিস্টার মিনিস্টার বলে অ্যাড্রেস করে। এটা নিয়ে বঙ্গবন্ধু পরে আমাকে বলেছেন যে, তুই বিলাতি কায়দায় চিঠি লিখিস। বিলাতে পড়েছিস তো! এই জন্য তুই চিঠি লিখেছিস, ডেয়ার মিস্টার মিনিস্টার বলে। ঐ চিঠিতে আমি লিখেছিলাম আই হ্যাভ টেকেন দিজ মানি ফ্রম ইস্ট পাকিস্তান। আই স্পেন্ড দিজ মানি ফর দ্যা ইনডিপেনডেন্স অব বাংলাদেশ অ্যান্ড দ্যা রেস্ট অ্যামাউন্ট ইজ রিডিপোজিডেট ইন দ্যা ব্যাংক এগেইন।



বঙ্গবন্ধু আমাকে আরো বললেন যে, এ রকম কেউ করে নাই। বাংলাদেশের ইতিহাসে টাকা নিয়ে গিয়ে তার হিসাব দেওয়া এবং পরবর্তীতে তা ফেরত দেয়ার নজির নাই। আমি এই নজিরটা স্থাপন করেছিলাম। আমার লক্ষ্য ছিলো একটাই। আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জ্বীবিত হয়েই মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। আমি আমার নিজের বিশ্বাস থেকে করেছি। মানুষের মুক্তির আকাঙ্খা থেকেই আমি এই কাজগুলো করেছিলাম। এটা আমার নৈতিক দায়িত্ব ছিলো।



আরো অনেক ঘটনা আছে যে ঘটনাগুলোর কথা আমার নিজেরও মনে হয় নাই। এখন একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। একদিন আমার সঙ্গে কে যেন ছিলো। তখন আবার আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের অফিসিয়াল তদন্ত হচ্ছিলো। পলিটিক্যালি অভিযোগ করা হয়েছিলো যে, উনি এখানে এসে জোর করে সব কিছু করছেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বললো যে, ঠিক আছে, ঐ এলাকায় আওয়ামী লীগের যারা আছে তাদেরকে একত্র করো। আমরা ওখানে তদন্তে যাবো। সেখানে তখন আওয়ামী লীগের নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী, ইউসুফ আলী, কে. এম. ওবায়দুর রহমান-ওনারা ওখানে এসেছিলেন। তদন্ত সভাটা পরে একটা সমাবেশে রূপ নেয়।

Popular posts from this blog

“নওগাঁয় মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা”

নওগাঁয় পূর্বের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে,মেলায় অবৈধ ব্যাবসা

দূর্নীতি ছেয়ে আছে নওগাঁ বিটিআরএ