ফুটপাতের মুচি থেকে কোটিপতি

বগুড়ার ধুনটে স্খাপন করা এনজিও ‘প্রতিকার’এর পরিচালক রতন রবিদাস এক বছর আগেও ফুটপাতে জুতা মেরামত করতো। আদিবাসী সমিতির সভাপতি হয়ে সদস্যদের টাকা আত্মসাৎ ও এনজিও খুলে দরিদ্র নারীদের প্রলোভন দিয়ে তাদের কাছে টাকা হাতিয়ে নিয়ে নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। অল্প সময়ে বনে যায় কোটিপতি। বাতিল নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীও হয়েছিলেন। তার প্রতারণা ফাঁস হলে সদস্যরা গত মঙ্গলবার রাতে তাকে আটক করে। শত শত নারী-পুরুষ টাকা ফেরত পেতে থানার সামনে অবস্খান নেয়। পুলিশ তিনদিনের রিমান্ড শেষে গতকাল বড় ভাই যতীশসহ তাকে হাজতে চালান দিয়েছে। তার ব্যাংক হিসাব ফিন্সজ ও নগদ টাকা, মাইক্রোবাসসহ বিভিন্ন সামগ্রী আটক করেছে। এসব বিক্রি করে সমিতির সদস্যদের টাকা ফেরত দেয়া হবে।

পরিচয়: ধুনট উপজেলার মহিশুরা গ্রামের হত দরিদ্র স্বর্গীয় মহর রবিদাসের আট ছেলেমেয়ের মধ্যে যতীশ বড় ও রতন মেজ। ১৯৭৮ সালে রতন জন্মগ্রহণ করে। পেশায় চর্মকার (মুচি)। নিজস্ব কোন জমিজমা ছিলনা। মহর মুচি ১০ সদস্যের পরিবার নিয়ে মহিশুরা বাজারে কৃষি বিভাগের ব্লক সুপারভাইজারের পরিত্যাক্ত কোয়ার্টারে বাস করতো। ১৯৯১ সালে মহর মারা যাবার পর পরিবারের সদস্যরা বিপাকে পড়ে। স্ত্রী রাজমনি দাস ঝাঁড়ুদারের কাজ করে। এতে সংসার না চললে মাত্র ১৩ বছর বয়সে রতন পৈতৃক সূত্রে পাওয়া চর্মকারের পেশা বেছে নেয়। সংসারে অভাবের কারণে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। গত ২০০২ সালে রতন জুতা মেরামতের কাজ করার জন্য ধুনট পৌর শহরে আসে। অল্প সময়ের মধ্যে সে দক্ষ মুচি হিসেবে সকলের কাছে পরিচিতি লাভ করে।

যেভাবে কোটিপতি: রতন ফুটপাতে বসে জুতার কাজ করার পাশাপাশি আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন দেখে। এর অংশ হিসেবে চারদলীয় জোট সরকারের সময় আদিবাসীদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়। প্রথমে আদিবাসীদের অধিকার আদায়ে বিভিন্ন গ্রামের মুচিদের ঐক্যবদ্ধ করে। প্রথমে ধুনট উপজেলায় কাজ শুরু করলেও পরে অন্যন্যা উপজেলায় সংগঠনের কাজ সম্প্রসারণ করেছে। গত ২০০৫ সালে রতন রবিদাস আদিবাসী সমিতি জেলা শাখার সভাপতি মনোনীত হয়। জেলা ও উপজেলা কমিটির সদস্যদের চাঁদা ও বিভিন্ন স্খান থেকে পাওয়া অনুদানের টাকার বেশির অংশ আত্মসাৎ করে। ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে। মুচির কাজ ছেড়ে আদিবাসীদের বড় নেতা বনে যায়। তাদের স্বার্থে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। গত বছরের ২২ জানুয়ারি বাতিল হওয়া নবম জাতীয় নির্বাচনে বগুড়া-৫ (শেরপুর-ধুনট) আসনে রতন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দাখিল করে। এরপর সে এনজিও প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে। গত বছরের ১৮ জুলাই ‘প্রতিকার’ নামে সমাজসেবা অধিদফতর থেকে রেজিষ্ট্রেশন (নং-১২৯২/০৭) গ্রহণ করে। ১১ নভেম্বর ধুনটের হাসপাতাল সড়কে ভাড়া বাসায় কাজ শুরু করে। প্রথমে সে আদিবাসী সদস্যদের মাঝে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম চালু করে। এ ব্যাপারে যুগান্তরে সচিত্র রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এর বৈধতা না থাকায় সমাজসেবা অধিদফতর গত ১২ মার্চ এ কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। এতে দমে যায়নি রতন রবিদাস। সে প্রতিষ্ঠানের নাম পাল্টিয়ে ‘প্রতিকার সমাজ কল্যাণ সোসাইটি’ করে। এলাকার গরীব ও বেকার মহিলাদের শাড়ি, থ্রি-পিস, পাঞ্জাবীসহ বিভিন্ন কাজে শর্ত সাপেক্ষে প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করে। ছয় হাজার ৫২৫ টাকা দিয়ে সদস্য হলে প্রতি সপ্তাহে ৪২০ হারে লাভ এবং ১০ মাসে ১৮ হাজার ৪৮০ টাকা ফেরতের প্রলোভন দেয়। পাশাপাশি বিনা খরচে হাতের কাজ শেখানোর প্রস্তাব দেয়। এ প্রলোভনে আশপাশের বিপুল সংখ্যক নারী সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে বা সহায় সম্বল বিক্রি করে ওই এনজিও’র সদস্য হন। মাত্র ছয় মাসের প্রায় নয় হাজার সদস্য হয়। গরীবদের এ টাকায় মুচি রতন রবিদাস কোটিপতি বনে যায়।

ঘটনা ফাঁস: গত প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে সাপ্তাহিক লাভ দেয়া বন্ধ করলে সদস্যদের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। রতন টাকা নিয়ে পালিয়ে যেতে পারে এ আশংকায় সদস্যরা জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে অভিযোগ করেন। এর প্রেক্ষিতে উপ-পরিচালক হারুন অর রশিদ গত মঙ্গলবার বিকালে ‘প্রতিকার’ কার্যালয় পরিদর্শনে যান। তিনি সমিতির লেনদেনের হিসাব চান ও পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। টের পেয়ে শত শত সদস্য প্রতিকারের পরিচালক রতন রবিদাস ও বড় ভাই নির্বাহী পরিচালক যতীশ রবিদাসকে অফিসে অবরুদ্ধ করেন। বিক্ষুব্ধরা যতীশকে মারধর করে।

যেভাবে গ্রেফতার হল: খবর পেয়ে ধুনট থানা পুলিশ রতন ও যতীশকে উদ্ধারের চেষ্টা করে। কিন্তু বিক্ষুব্ধ সদস্যদের বাধার কারণে সম্ভব হয়নি। এরপর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ হারুন, পৌর মেয়র আলিমুদ্দিন হারুন মন্ডল, ওসি রফিকুল আলম ও সমাজসেবা কর্মকর্তা সহিদুল ইসলাম খাঁন ঘটনাস্খলে যান। তারা টাকা ফেরতের আশ্বাস দিলে সদস্যরা সাময়িক শান্ত হন। পুলিশ রাত ৩টার দিকে দু’জনকে থানায় নিয়ে আসে।

ক্ষতিগ্রস্তদের থানার সামনে অবস্খান ও বিক্ষোভ: এদিকে বুধবার সকাল থেকে শত শত নারী-পুরুষ ধুনট থানার সামনে অবস্খান ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। পরিস্খিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কাজেম উদ্দিনের নেতৃত্বে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। বিকালে পুলিশের আশ্বাসে জনগণ শান্ত হন।

মামলা ও রিমান্ড: উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম খাঁন বাদী হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা ও প্রতারণার অভিযোগে দু’ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করেন। আর্জিতে প্রাথমিকভাবে কোটি টাকা আত্মাসাতের অভিযোগ আনা হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তা দারোগা ইব্রাহীম খাঁন গত বৃহস্পতিবার বিকালে দু’ভাইকে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে হাজির করে পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। বিচারক তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। দারোগা ইব্রাহীম জানান, রিমান্ড শেষে রোববার দুপুরে তাদের হাজতে চালান দেয়া হয়েছে। রিমান্ড চলাকালে ক্ষতিগ্রস্তরা থানার সামনে দিনভর ভিড় করেন। এ সময় তারা আরও যেসব তথ্য দিয়েছে পুলিশ তা খতিয়ে দেখছে।

ব্যাংক হিসাব ফিন্সজ, গাড়ী ও টাকা উদ্ধার: পুলিশ টাঙ্গাইল থেকে তাদের মালিকানাধীন একটি মাইক্রোবাস, একটি মোটরসাইকেল, বাড়ি থেকে নগদ তিন লাখ ৬৫ হাজার টাকা ও অফিস থেকে ৪০০ পিস শাড়ি উদ্ধার করেছে। এছাড়া ধুনট পৌর এলাকায় ২২ শতাংশ জমির সন্ধান পাওয়া গেছে। সমিতির অগ্রণী ব্যাংক ধুনট শাখায় থাকা ছয় লাখ আট হাজার ২০০ টাকা ফিন্সজ করা হয়েছে। এছাড়াও বাড়ি ও অফিস থেকে কিছু মূল্যবান আসবাবপত্র জব্দ করা হয়। ধুনট পৌরসভার মেয়র আলিমুদ্দিন হারুন মন্ডল জানান, এসব বিক্রি করে সদস্যদের টাকা ফেরত দেয়া হবে।

বর্তমান অবস্খা: রতন রবিদাসের পরিবারের অন্য সদস্যরা গ্রেফতার বা জনরোষের ভয়ে আত্মগোপন করেছেন। গতকাল পর্যন্ত প্রায় ছয় হাজার সদস্যর নাম পাওয়া গেছে। উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা সদস্যদের তালিকা যাচাই বাচাই করছেন। শিগগিরই সদস্যদের মাঝে টাকা ফেরত দেয়া হবে। তবে পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা দাবি করছেন সমিতির সদস্যদের পাওনা অর্ধ কোটির বেশি হবেনা।

মূল প্রতিবেদন নওয়াই বাংলা থেকে নেওয়া

Popular posts from this blog

“নওগাঁয় মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা”

নওগাঁয় পূর্বের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে,মেলায় অবৈধ ব্যাবসা

দূর্নীতি ছেয়ে আছে নওগাঁ বিটিআরএ