একজন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল জলিলের সাক্ষাত্কার শেষ পর্ব

প্র : এটা কোন্‌ মাসের দিকে?

উ : এটা অগাস্টের দিকে হবে। সেদিন ওখানে প্রায় ২০/২৫ হাজার মানুষ জমায়েত হয়েছিলো। যারা মুক্তিযুদ্ধে এসেছিলো বা যারা শরণার্থী ছিলো তারা সবাই খবর পেয়ে জমায়েত হয়েছিলো ওখানে।

প্র : সভা স্থল কোথায় ছিলো?

উ : এটা বালুরঘাট শহরে। ওখানে ঐ মিটিংয়েই লোকজন চারিদিক থেকে আমার পক্ষে স্লোগান এবং আমার বিপক্ষে যারা অভিযোগ করেছিলো তাদের ধিক্কার দিয়ে স্লোগান দিয়েছিলো। তখন ওখানেই ‘উত্তরবঙ্গ মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’ হলো। ওনারাই সেটা করে দিয়ে গেলেন। আমাকে তাঁরা এই কমিটির কনভেনর করে দিয়ে গেলেন আর বাকি ছয়জনকে কমিটির মেম্বার করে দিলেন। এই ছয়জনের মধ্যে ঐ যে অভিযোগ যারা করেছিলেন তাদের মধ্য থেকে চারজন এম.পি.ও ছিলেন। সাত সদস্য বিশিষ্ট একটা কমিটি ওনারা করে দিয়ে গেলেন। এই কমিটি পরবর্তীকালে ঐ এলাকার যাবতীয় কাজ কো-অর্ডিনেট করেছে। ঐ এলাকার মুক্তিযুদ্ধের অফিসিয়াল কো-অর্ডিনেশনের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার থেকে পরে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো। পরবর্তীকালে নানা ধরনের বিরোধিতার পরও আমি যেটা বলবো, আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছি তাদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের নিরপেক্ষ সমর্থনটা, সহযোগিতাটা আমি বেশি পেয়েছি। আমি তাদেরকে যেমন করেছি, তারাও আমাকে সেভাবে সহযোগিতা দিয়েছেন। সমন্বিতভাবে মিলিতভাবে কাজ করায় ঐ এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের জন্য মানুষের মধ্যে একটা নতুন চেতনার সৃষ্টি হয়েছিলো। যার জন্যে ঐ এলাকায় আমি নিজেই ৬/৭টা ক্যাম্প পরিচালনা করতে পেরেছিলাম।

প্র : ক্যাম্পের নামগুলো বলতে পারবেন?

উ : বাঙালিপুর, মধুপুর, সোবরা, পতিরাম, পারিলা, তপন এবং গৌরবাগানে ক্যাম্প ছিলো। আরো ২/৩টা ছিলো। সব নাম এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। যাহোক, এই ক্যাম্পগুলো আমি অরগানাইজ করেছি। এছাড়াও মালদা থেকে আরম্ভ করে পশ্চিম দিনাজপুরে যতগুলো শরণার্থী ক্যাম্প ছিলো সমস্ত শরণার্থী ক্যাম্প আমি কো-অর্ডিনেট করেছি। পাশাপাশি আমাদের যারা যুদ্ধ করতে পারবে না, একটু বয়স্ক মানুষ তাদের দিয়ে বা ছেলেমেয়ে সমন্বয়ে ৩/৪ জন কর ভলেনটিয়ার টিম করে করে শরণার্থীদের খোঁজ খবর নিয়েছি। তাদের অসুখ-বিসুখ হলো কি না, সাহায্য দরকার কি না এ সব খবরের জন্য পুরো এলাকাতে একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে তাদের সেবা করার চেষ্টা করেছি। মুক্তিযুদ্ধের এমন একটা অবস্থায় মানুষের মধ্যে যেন হতাশার সৃষ্টি না হয়, মানুষের মধ্যে যেন স্বদেশ চেতনা সৃষ্টি হয়, এজন্য টিমগুলো তাদের নিয়ে বসেছে, কথা বলেছে, উদ্বুদ্ধ করেছে, উৎসাহিত করেছে। লোকাল সাহায্য বা রিলিফ যেটা আসছে সেটা যেন সুষ্ঠুভাবে সবাই পায় সেটা তদারক করার জন্য ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিলো। একদিক মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছি, অন্যদিকে ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করেছি। আরেকদিকে শরণার্থীদের যেন কোনো রকম অসুবিধা না হয় তার জন্য টিম করে দিয়ে প্রত্যেকটা ক্যাম্পে আমাদের প্রতিনিধিকে দিয়ে আমরা কাজ করিয়েছি। সুতরাং ঐ এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের একটা সুষ্ঠু ও সুস্থ পরিবেশ বিরাজমান ছিলো।
ঐ সময়ের আর একটা ঘটনা আছে, সেটা এর সাথে যারা সংশ্লিষ্ট ছিলেন কেবল তারাই শুধু জানেন। আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থীদের অবস্থা দেখার জন্য এডওয়ার্ড কেনেডি ভারতে এসেছিলেন। এটা মনে হয় অক্টোবরের শেষে। তখন কিন্তু শরণার্থীদের ইন ফ্লো ইন ইন্ডিয়া একেবারে কমে গেছে। খুবই কম তখন আসছিলো। ঐ সময় একদিন পশ্চিম দিনাজপুরের ডি. এম. আমাকে ডাকলেন। সেখানে আর্মির প্রতিনিধি সহ অন্যান্য এজেন্সির লোকজনও ছিলো। তারা আমাকে ডেকে বললেন যে, আপনাকে একটা কাজ অর্গানাইজ করতে হবে। আমি বলি কি? তারা বললেন এই এলাকায় ইন ফ্লো অব রিফিউজি দেখাতে হবে। এডওয়ার্ড কেনেডি এখানে আসবেন। উনি এটা দেখতে চান।কুচবিহার ও পশ্চিম দিনাজপুরের বর্ডারে ইসলামপুর বলে একটা জায়গা আছে। এটা হচ্ছে পশ্চিম দিনাজপুরের সাবডিভিশনাল হেডকোয়ার্টার। পঞ্চগড়ের অপজিটে যে নদীটা ঐ নদীর ওখানেই আমাদের শরণার্থী ক্যাম্পগুলো ছিলো। ওখানে কিছু বনজঙ্গল আছে। শালবন আছে। ঐ দিক দিয়েই শরণার্থীরা নদীটা পার হয়ে ইসলামপুরে আশ্রয় নেয়।
তখন শরণার্থী আসা একেবারেই কমে গেছে। কিন্তু এখনও তারা আসছে এটা আমাকে দেখাতে হবে। ইন্ডিয়ান সরকার থেকে বললো এবং আমাদের বাংলাদেশ সরকার থেকেও বললো যে, তোমার কাসটোডিতেই এখন পুরো ব্যাপারটা। তুমি যা চাইবে তাই তোমাকে দেয়া হবে। বাট ইউ হ্যাভ টু অর্গানাইজ দিজ। আমি ইসলামপুরে গেলাম। গিয়ে দেখলাম যে, আশে পাশে কতগুলো ক্যাম্প আছে। চিন্তা করে ঠিক করলাম যে, সব ক্যাম্প আগে ঘুরে দেখি যে, রিসেন্ট কারা কারা আসছে। পায়ের অবস্থা দেখে তো বোঝা যায় যে রিসেন্ট কারা এসেছে। এই করে করে আমি তিন চারশ’ নতুন আসা রিফিউজি জমা করলাম।তারপর আমি প্লান করলাম যে, যেদিন সকাল বেলা কেনেডি আসবেন, তাঁর আসার কথা হেলিকপ্টারে, সকাল নয়টা সাড়ে নয়টার দিকে, তার আগের দিন ভোর বেলা দ্যাট ইজ মিড নাইটে আমি নতুন আসা শরণার্থীদের নদী ক্রস করে জঙ্গলের দিকে দিয়ে দেবো। যারা রিসেন্ট এসেছে এ রকম ৪/৫শ’ আমি জোগাড় করতে পেরেছিলাম। সকালে তারা হেঁটে আসছে - এই দৃশ্যটা কেনেডিকে দেখাবো। এ জন্য শরণার্থীরা একজায়গায় এসে জড়ো হয়েছে। তাদের হাত পা যে টুকু রিপিয়ার হয়েছে সেটা নতুন করে হাঁটলে তো আবার ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এই পরিকল্পনা করে আমি ৩/৪ দিন ওখানে ঘুরে ঘুরে সমস্ত ঠিকঠাক করে ফেললাম। ভাবলাম যে, কেনেডিকে কনভিন্স করার জন্য দেখানো যাবে যে, রিফিউজি ইন ফ্লো স্টিল দেয়ার অ্যান্ড দে আর কামিং।
যাহোক, তাঁর আসার আগের দিন সব রেডি করে ভোর বেলা মানে রাত চারটার দিকে শরণার্থীদের নদীর ওপার যখন পাঠাবো তখন একটা মেসেজ আসলো যে, কেনেডি ইসলামপুরে আসবেন না। উনি কলকাতার আশেপাশে যে রিফিউজি ক্যাম্পগুলো দেখেছেন সেগুলো দেখেই নাকি তিনি বলেছেন যে, আমার আর কোনোটা দেখার দরকার নেই। আমি কনভিন্সড যে, শরণার্থীদের ইন ফ্লো এখনও আছে এবং মানুষ পূর্ব পাকিস্তানে অত্যাচারিত হচ্ছে। তারা দেশে থাকতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত কেনেডি আর ইসলামপুরে আসলেন না। তখন আমি আবার আমার কাজ কর্ম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আমি শহরের বাইরে শ্মাশান ঘাটের উপর একটা বাসায় থাকতাম। সে সময় প্রতিদিনই আমার বাসায় অনেক ছেলেপেলে আসতো মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য। আমি তাদের ট্রাকে করে নিয়ে যেতাম ক্যাম্পে। তখন আমার পরিচালিত ক্যাম্পে সব সময়ই ২/৩ হাজার ছেলেপেলে ট্রেনিং নিতো। এই ট্রেনিং মানে ফিজিক্যাল ট্রেনিং এবং অস্ত্রের প্রাথমিক ট্রেনিং। তারপর ওখান থেকে বেটার ট্রেনিংয়ে সব যেতো। হায়ার ট্রেনিংয়ে তারা কেউ শিলিগুড়িতে, কেউ রায়গঞ্জে যেতো। এ সব কিছুই হতো আমার মাধ্যমে। সেদিন ৬ ডিসেম্বর আমি বাসা থেকে বের হবো, এমন সময় দেখি আর্মির এক কনভয় এসে আমার বাড়ির সামনে দাঁড়ালো।
প্র : এটা কোথায়?

উ : বালুরঘাটে। এর আগেও ইন্ডিয়ান আর্মি অফিসাররা আমার বাসায় এসেছে। কোনো সময় তারা আমার ক্যাম্পে যায় বা রাস্তাঘাটেও তাদের সাথে দেখা হয়। সেদিন বিরাট এক কনভয় এসে আমার বাসার সামনে দাঁড়ালো। দেখলাম এক উচ্চ পদস্থ আর্মি অফিসার গাড়ি থেকে নামছেন। আমি ভাবলাম, কি ব্যাপার হঠাৎ! ওনার নাম এখন আমার ঠিক খেয়াল নাই। উনি নেমে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন যে, মি: জলিল, আপকা আজাদী মিল গিয়া। আমি বলি যে, হাউ ইট কুড বি! উই আর স্টিল ফাইটিং। ইউর গভর্নমেন্ট হ্যাজ নট ইয়েট রিকোগনাইজ। যদিও তোমাদের সরকার আমাদের সব রকম সাহায্য করছে, বাট ইউ হ্যাভ নট বিন রিকোগনাইজ ইয়েট অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড কমিউনিটি হ্যাভ নট এক্সসেপ্টটেড দিজ। হাউ উই ক্যান গেট দিজ? উনি বললেন যে, ইন্দিরাজী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছেন, আওয়ার গর্ভনমেন্ট হ্যাজ রিকোগনাইজ টুডে, সিক্সথ ডিসেম্বর, অ্যান্ড ইউ উইল গেট দ্যা ইনডিপেনডেন্স উইদিন টেন ডেজ।

প্র : এটা ডিসেম্বরের ৬ তারিখের ঘটনা?

উ : হ্যাঁ, ৬ তারিখের ঘটনা এবং উনি জোর দিয়েই বললেন, তোমরা খুব দ্রুতই স্বাধীনতা পাচ্ছো। সত্যিই তো আমরা ৬ ডিসেম্বরের দশ দিন পরে আমরা বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলাম। এ প্রসঙ্গে ভারতের সহযোগিতার কথা আমাকে বিশেষভাবে বলতে হয়। ভারতের সহযোগিতার কথা যদি না বলি তাহলে আমার অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দেয়া হবে। ডিউরিং দ্যা এনটায়ার লিবারেশন ওয়ার দ্যায়ার কো-অপারেশন, অ্যাসিসটেন্স, ফিজিক্যাল হেলপ উই রিসিভড ফ্রম দ্যা ইন্ডিয়ান গর্ভনমেন্ট, ফ্রম দ্যা ইন্ডিয়ান পিপল। একটা দেশে এক কোটি মানুষ যাবার পরে ন্যাচারেলি সে দেশের সমাজে একটা বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছিলো। তারপরও কিন্তু সে সমাজের প্রতিটি মানুষ আমাদের প্রতি যে সমবেদনা, সহনশীলতা দিয়ে সাহায্য করেছে, এক কথায় দিজ ইজ ইউনিক। আমার মনে হয়, একটা জাতির, একটা মুক্তিকামী মানুষের প্রতি তাদের যে সমর্থন, যে বিশ্বাস বা তাদের যে ভালোবাসা এটা একটা নজিরবিহীন ইতিহাস।আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাদের তো রক্ত দেওয়ার কথা ছিলো না। জীবন দেওয়ার কথা ছিলো না। কিন্তু তারা দিয়েছে। এই কৃতজ্ঞতাবোধটা তো আমাদের বাঙালি জাতির থাকতে হবে। যদি আমি এই কৃতজ্ঞতাবোধটা প্রকাশ না করি - তাহলে আমি মনে করি মনুষ্যত্বের ডেফিনেশনের বাইরে আমি থাকবো, আমাকে পশুত্বের ডেফিনেশনে যেতে হবে। আমার নেতা বঙ্গবন্ধু একটা কথা বলেছিলেন যে, আমরা অকৃতজ্ঞ জাতি নই। ভারতের জনগণ, ভারতের সরকারের কাছে, ভারতের সেনাবাহিনীর কাছে চিরদিন আমরা কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ। তাদের সহযোগিতা, তাদের সমর্থন ছাড়া আমাদের এই মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করা দু:সাধ্য হয়ে পড়তো। এটা বিবেচনায় নিতে হবে। স্বীকার করতে হবে। সুতরাং কৃতজ্ঞ জাতি হিসাবে ভারতের এই অবদানকে চিরদিন এই জাতিকে শ্রদ্ধাবনতভাবে স্বীকার করে কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ থাকতে হবে।ঐ এলাকায় যখন আমি সাধারণ মানুষ হিসাবে ঘোরাফেরা করেছি, তখন আমি দেখেছি যে, সেখানকার মানুষের মধ্যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি কি সমর্থন, কি ভালোবাসা, বিশেষভাবে বাঙালিদের। আমাদের চেয়ে বেশি গর্বের বিষয় ছিলো তাদের। তারা বেশি গর্ব বোধ করতো যে, বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধ করে একটা স্বাধীন বাংলাদেশ কায়েম করতে যাচ্ছে। যদিও তারা সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারছে না। কিন্তু সমর্থনের মধ্যদিয়েই তাদের যে আকাঙ্খা তার বহির্প্রকাশ তারা ঘটিয়েছে। সুতরাং একটা জাতি হিসাবে আমি মনে করি, আমাদের উচিত ভারতের সঙ্গে বন্ধু হিসেবে চিরদিনের একটা সুসম্পর্ক বজায় রাখা। এর মধ্যে দিয়েই আমার মনে হয় যে আমরা সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারবো।
প্র : আপনার এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা কখন তৎপরতা শুরু করে অর্থাৎ তারা ভারতে ট্রেনিং নেওয়ার পর তাদেরকে কখন বাংলাদেশের ভেতরে পাঠানো শুরু করলেন?
উ : প্রথম ব্যাচ পাঠিয়েছি মে মাসের শেষে অথবা জুনের প্রথম দিকে। আসলে জুন মাস থেকে ট্রেনিং দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া শুরু করলাম।
প্র : নওগাঁ এলাকায় উল্লেখযোগ্য অপারেশন কোথায় কোথায় হয়েছে-এ সম্পর্কে আপনি কিছু বলতে পারবেন কি?
উ : এটা তো অনেক জায়গায় হয়েছে। যেমন ইন্ডিয়ান বর্ডারে অনেক হয়েছে। বস্তাবরে হয়েছে। তারপরে ভিতরে বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধ হয়েছে। নওগাঁ টাউনের পাশেই যুদ্ধ হয়েছে-যেখানে ৪/৫ জন মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছে। তারপর আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বগুড়ার আদমদীঘির এই সাইডে যুদ্ধ করেছে, রানীনগরে যুদ্ধ করেছে, আত্রাই এবং বান্ধাইঘরাতে যুদ্ধ হয়েছে। এই রকম অনেক যুদ্ধক্ষেত্র আছে। এখন সঠিক স্পটগুলোর কথা বলতে হলে আমাকে একটু চিন্তা করতে হবে। এই মুহূর্তে হঠাৎ মনে করতে পারছি না। তারপরে পাঁচবিবির ওখানে একটা স্কুল ছিলো, এখন নামটা মনে করতে পারছি না, ওখানে আর্মি, পুলিশ, আনসার, ইপিআর-এর সমন্বয়ে গঠিত মুক্তিবাহিনীর একটা টিম পাঠিয়ে ছিলাম। ওখানে যুদ্ধ হয়েছে। তারপর আমাদের ঐ এলাকায় সবচেয়ে বড় ট্যাঙ্ক ব্যাটেল হয়েছে।
প্র : মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে অবস্থানরত সাধারণ মানুষের ধারণা কেমন ছিলো-এ সম্পর্কে কি জানেন?
উ : মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সাধারণ মানুষের প্রচন্ড সিমপ্যাথি ছিলো, বিশ্বাস ছিলো। মানুষ মনে করতো তারাই হচ্ছে আশ্রয় স্থল তাদের বেঁচে থাকার জন্য। কারণ পাকিস্তান সেনাবাহিনী, রাজাকার, আল-বদরদের অত্যাচার, নিপীড়নে প্রতিটি মানুষ একটা আশ্রয়ের আকাঙ্খায় ছিলো। একটা গ্রামে যখনই মুক্তিযোদ্ধারা যেতো তারা মনে করতো এবার আমাদের একটা অবলম্বন আসছে। সবাই তাদেরকে সমর্থন দিতো এবং সব দিক দিয়েই কো-অপারেশন করতো। মুক্তিযোদ্ধারা মানুষের ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলো তাদের কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে। একদিকে পাকিস্তানিদের অত্যাচার, রাজাকারদের অত্যাচার, আরেকদিকে তাদের বিরুদ্ধে যে লড়াই, সংগ্রাম, সেই লড়াই সংগ্রামের মধ্যদিয়ে অত্যাচারী বাহিনীকে মুক্তিযোদ্ধারা পরাজিত করেছে। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধারা সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করেছিলো, তারা ভালোবাসা পেয়েছিলো।
প্র : মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনার এলাকা ৭ নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। মেজর নজমুল হক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর কর্নেল কাজী নুরুজ্জামানকে ৭ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাঁর সাথে আপনার যোগাযোগ বা সম্পর্ক কেমন ছিলো?

উ : মেজর নজমুলের সঙ্গে আমার খুবই ভালো সম্পর্ক ছিলো। কর্নেল নুরুজ্জামানের সঙ্গে তেমন ছিলো না। নজমুল হক যখন ছিলেন তখন ফিল্ড লেবেলে মুক্তিযুদ্ধকে অর্গানাইজ করার ব্যাপার ছিলো। সে কাজ আমরা দু’জনই করেছি। তারপর উনি নওগাঁ ইপিআর উইংয়ের কমান্ডার ছিলেন। এ কারণে তার সাথে আমার আগে থেকেই ভালো সম্পর্ক হয়েছিলো। কর্নেল নুরুজ্জামান যখন চার্জ নিলেন তখন তো প্রতিদিন সীমান্তে যুদ্ধ হচ্ছে। এভরি ডে ফাইট ওন। আমি তখন ফিল্ডে ব্যস্ত ছিলাম। আমাকে যুদ্ধ ছাড়াও আরো নানা কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। ফলে, তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগের তেমন সুযোগ ঘটেনি।
প্র : মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জোনাল কাউন্সিল গঠন করা হয়েছিলো। আপনার এলাকার জোনাল কাউন্সিল সম্পর্কে আপনি কি জানেন?

উ : আমাদের এলাকায়ও জোনাল কাউন্সিল করা হয়েছিলো। জোনাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন দিনাজপুরের আবদুর রহিম সাহেব। অ্যাডমিনিসট্রেটিভ মেকানিজমের ধারাবাহিকতায় তাদের কিছু দায়িত্ব ছিলো। তখনকার পরিস্থিতিতে গ্রাউন্ড লেবেলে তারা তেমন কিছু করতে পারেনি। যারা ডাইরেক্ট মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলো তাদের একটা দায়িত্ব ছিলো। জোনাল কাউন্সিল মুক্তিযুদ্ধের নানা বিষয়গুলিকে কো-অর্ডিনেট করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে অফিসিয়ালি বিভিন্ন সময় যে নির্দেশনা আসতো সেটা তারা করার চেষ্টা করেছে। তাদের এই তৎপরতা চোখে পড়ার মতো ছিলো না। তাদের কোনো অফিস ছিলো না। ফলে, অফিসকেন্দ্রিক কোনো কর্মকান্ডও ছিলো না। অন্যদিকে মাঠ পর্যায়ে ইফেকটিভ ছিলো তারাই দোজ ওয়্যার ডাইরেক্টলি ইনভল্বড ইন ফ্রীডম ফাইটিং। মাঠ পর্যায়ে তারাই ইফেকটিভলি তাদের দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে। আর যারা ঐভাবে যুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নয় তাদের তো সেখানে তেমন করার কিছু ছিলো না।

প্র : মুজিব বাহিনী সম্পর্কে আপনি কি জানেন?

উ : মুজিব বাহিনী গঠন সম্পর্কে আমি ঠিক জানি না। এটা আমি ঠিক বলতে পারবো না। আমি যেটুকু শোনার পরবর্তীতে শুনেছি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিশেষত: ইয়াং ফোর্সরা, তাদের একটা ধারণা ছিলো এবং ইন্ডিয়ান একটা ফ্রাকশন থেকেও বলা হয়েছিলো যে, এই মুক্তিযুদ্ধ প্রলম্বিত হবে। প্রলম্বিত মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা পলিটিক্যাল বাহিনী দরকার। সেই পলিটিক্যাল বাহিনী হিসাবে তারা ‘মুজিব বাহিনী’ গঠন করেছিলো ফিলোসফিক্যাল মডেল হিসাবে। যদি মুক্তিযুদ্ধ প্রলম্বিত হয় তাহলে এই প্রলম্বিত মুক্তিযুদ্ধে এরা পিপলকে অরগানাইজ করবে এবং পিপলকে সংঘবদ্ধ করেই মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য হাসিলের জন্য তারা কাজ করবে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নয় মাসে সমাপ্ত হওয়ার ফলে এই মুজিব বাহিনী তাদের সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার কোনো সুযোগ পায়নি।
প্র : আমরা শুনেছি সেই সময় বিভিন্ন সেক্টরে মুজিব বাহিনী এবং এফ.এফ. যাদেরকে আমরা বলি তাদের মধ্যে কোথাও কোথাও সংঘাত-সংঘর্ষ হয়েছে। এ সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন কি?

উ : এ সম্বন্ধেও আমার কোনো ধারণা নেই। তবে আমার সৌভাগ্য যে, আমি যে এলাকাগুলোতে দায়িত্ব পালন করেছি বা মুক্তিযুদ্ধ অরগানাইজ করেছি সেখানে মুক্তিবাহিনীর দায়িত্ব আমার উপর ছিলো। পাশাপাশি মুজিব বাহিনীর কো-অর্ডিনেশনের দায়িত্বও আমার হাতেই ছিলো। এ এলাকায় মুজিব বাহিনীর যে ইনডাকশন হতো, তৎপরতা হতো তার সব কিছু সুপারভিশনের দায়িত্ব আমার উপরেই ছিলো। আমার ওপর দুই গ্রুপেরই সমন্বয়ের দায়িত্ব ছিলো। সুতরাং ঐ ডিফারেন্সটা ওখানে আমি কাউকে করতেও দেখিনি বা হতেও দেইনি।
প্র : আপনি জানেন যে, বাংলাদেশ সরকার ১০ এপ্রিল গঠিত হয়। পরবর্তীতে ১৭ এপ্রিল ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীবর্গ প্রকাশ্যে শপথ নিলেন-এই সরকার সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ণ কি?

উ : ঐ সময় তো মুজিবনগর সরকার ঐতিহাসিকভাবেই তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। মুজিবনগর সরকার গঠিত না হলে এই মুক্তিযুদ্ধকে তো বিশ্ব স্বীকৃতিই দিতো না। সারা বিশ্বের সমর্থন আদায়ের জন্য এবং স্বীকৃতির জন্য একটা সরকারের প্রয়োজন ছিলো। একটা দেশ স্বীকৃতিটা কাকে দেবে? তার জন্যও তো একটা সরকারের প্রয়োজন। এই আলটিমেট নেসেসিটির জন্যই মুজিবনগর সরকারের সৃষ্টি হয়েছিলো। যে পারপাসে মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছিলো সেটা তারা সাকসেসফুলি করতে পেরেছে। দে সার্ভ দেয়ার পারপাস। তারা অরগানাইজ করেছে। বিশ্ব জনমত সৃষ্টির ক্ষেত্রে তারা ভূমিকা রেখেছে এবং মুক্তিযুদ্ধকে কো-অর্ডিনেট করে সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। মুজিবনগর সরকারের সাথে ইন্ডিয়ান সরকারেরও একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে, ওয়ার্কিং কো-অপারেশন-এইগুলো সব সমন্বিত হয়েছে, আন্ডার দ্যা লিডারশীপ অব মুজিবনগর সরকার। যে উদ্দেশ্যে মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছিলো সেই উদ্দেশ্য, লক্ষ্য সব কিছুই তারা অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে পরিচালনা করে সফলতার মধ্যদিয়ে মুক্তিযুদ্ধ লীড করে নিয়ে গিয়ে আমাদের স্বাধীনতার বিজয়কে ছিনিয়ে আনতে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছে।

প্র : মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আওয়ামী লীগেরই একটা অংশ মুজিবনগর সরকারের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করেছিলো। আবার মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে আওয়ামী যুব নেতৃত্বের একটা দ্বন্দ্ব ছিলো বলে মনে করা হয়। এ বিষয়ে আপনি কিছু জানেন কি?

উ : আমি যতদূর জানি, মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে আওয়ামী যুব নেতৃত্বের কোনো দ্বন্দ্ব বা সংঘাত ছিলো না। সেভাবে আমরা দেখি নাই। মুজিবনগর সরকারের কর্তৃত্বকে মেনে নিয়ে এবং তার নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। এক্ষেত্রে নো বডি চ্যালেঞ্জ মুজিবনগর গভর্নমেন্ট। যদিও একদিকে মুক্তিযোদ্ধারা আরেক দিকে মুজিব বাহিনী। কিন্তু দু’টার ফিলোসফি কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। মুক্তিযোদ্ধারা ভিক্টোরি অর্জনের জন্য যুদ্ধ করেছে এবং তারা মনে করেছে যুদ্ধের মধ্যদিয়েই এই সংগ্রামের সমাপ্তি টানতে হবে। আর মুজিব বাহিনীর কথা হলো এই যুদ্ধের পরেও আর একটা যুদ্ধ আছে। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য তাদের কিছু করণীয় আছে। সেই করণীয় বা দায়িত্ব পলিটিক্যালি তাদের করতে হবে। সেই লক্ষ্য নিয়েই তারা মুজিব বাহিনীকে অরগানাজ করেছে, মটিভেট করেছে। প্রকৃত অর্থে মুজিব বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বা সরকারের কোনো দ্বন্দ্ব ছিলো না।
আমরা তো জানি মুজিবনগর সরকারের মধ্যে খন্দকার মোশতাক ছিলেন। যিনি পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেন। এই খন্দকার মোশতাক মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস করে নাই। মুজিবনগর সরকারের ক্যাবিনেটে থেকেও সে সাবোট্যাজ করার চেষ্টা করেছে এবং সে পাকিস্তানের সঙ্গে একটা কনফেডারেশনের চেষ্টা করেছে। তাঁর ব্যাপারে আমি নিজেই একটা ঘটনার সাক্ষি। ঘটনাটা বলি: মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর প্রতিরোধ পর্বে নওগাঁ থেকে এক পর্যায়ে মেজর নজমুল হক ঐ যে চলে গেলেন তারপর তাকে খুঁজে পেলাম অনেক পরে। বাই দিস টাইম ক্যাপ্টেন আনোয়ার যুদ্ধের ফিল্ড লেবেলে নেতৃত্বে এসেছে। যিনি ৭ নং সেক্টরের প্রথম সেক্টর কমান্ডার ছিলেন বলা যায়। মেজর নজমুলকে খুঁজে পাওয়ার পর একটা সমস্যা হলো। মেজর নজমুল ইজ সিনিয়র ম্যান, হি কান্ট সার্ভ আন্ডার এ জুনিয়র অফিসার।ফলে, আমি তাকে নিয়ে কলকাতায় গেলাম অর্থাৎ মুজিবনগরে গেলাম। সেখানে গিয়ে আমি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সাথে দেখা করলাম। পরে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম। পরে খন্দকার মোশতাক ছাড়া অন্য দুই মন্ত্রীর সাথেও দেখা করলাম। ওনারা সবাই বললেন যে, তুমি এ ব্যাপারে ওসমানীর সঙ্গে কথা বলো। তখন আমি জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে দেখা করলাম। জেনারেল ওসমানীকে বললাম যে, দিস অ্যাপোয়েন্টমেন্ট স্যুড বি চেঞ্জ। তখন তিনি সাথে সাথে মেজর নজমুল হককে ৭ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার করে দিলেন এবং ক্যাপ্টেন আনোয়ারকে বললেন চার্জ হ্যান্ডওভার করতে।

এটা করে আমি আবার প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তখন তাজউদ্দীন সাহেব বললেন যে, তুমি অবশ্যই খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে দেখা করে যেও। আমি বললাম ঠিক আছে। আমি খন্দকার মোশতাক আহমেদের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। আমি রুমে ঢোকার সাথে সাথে খন্দকার মোশতাক স্টার্টেড সাউটিং, ইউ ব্লাডি ইয়াং পিপল, আই ডিডনট বিলিভ ইন দিস ব্লাডি ওয়ার। আই ওয়ান্ট টু সলভ দি প্রোবলেম থ্রো ডেমোক্রেটিক ওয়ে। তোমরা যুদ্ধ করে দেশকে এই জায়গায় নিয়ে গেছো। তোমরা যুদ্ধ করো। আই ডিডনট বিলিভ দিজ ব্লাডি ওয়ার। তার এইসব কথায় আমি প্রথমে একটু বোকাই বনে গেলাম। আমি বললাম যে, হোয়াট ইউ আর টকিং মোশতাক ভাই! এই সময় এই কথার কি মূল্য আছে? উনি বলে আই ডোন্ট বিলিভ দিজ ওয়ার।

উনার ঘর থেকে বেরিয়ে আমি তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে আবার দেখা করতে গেলাম এবং খন্দকার মোশতাক যা যা আমাকে বললেন-সব তাঁকে জানালাম। তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, তোমাকে তো পাঠালাম এই জন্যই। তাঁর সাথে তোমরা কেউ দেখা টেখা করো না। সে সাবোট্যাজ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমরা তাকে বের করে দেবো না। তাতে আমাদের ক্ষতি হবে। তাকে মন্ত্রিসভায় রাখবো।

খন্দকার মোশতাকের ঐ সব কর্মকান্ডের জন্য ভারত সরকারও তার চলাফেরা রেসট্রিকটেড করে দিয়েছিলো। সেজন্য বাংলাদেশ সরকারের মিনিস্ট্রি অব ফরেন অ্যাফেয়ার্সের পক্ষ থেকে আবদুস সামাদ আজাদসহ অন্যান্যরা বিশ্বব্যাপী ঘুরে বেড়িয়েছেন বিশ্বজনমত সৃষ্টির জন্য। ভিতরে এই কনট্রাডিকশনটা ছিলো। এটা ছিলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক। সামগ্রিকভাবে কোনো কনট্রাডিকশন মন্ত্রিসভায় ছিলো না। তাজউদ্দীন সাহেব কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান ছিলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম অ্যাকটিং প্রেসিডেন্ট এবং মন্ত্রীসভার অন্যান্য সদস্য-কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, দে ওয়ার্ক অল টুগেদার্স ইউনাইটেডলি। সুতরাং মুজিবনগর ক্যাবিনেটে কোনো দ্বন্দ্ব ছিলো না। ডিফারেন্ট অ্যাটিচ্যুড বা ভিউজ ছিলো বলেই আমি মনে করি।

প্র : আপনাদের সঙ্গে বা মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের সম্পর্ক কেমন ছিলো?

উ : ভারতের সাথে সম্পর্ক ভালো না থাকলে কি ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের জন্য ঐ ভাবে এগিয়ে আসে? এটা যদিও প্রাসঙ্গিক নয় তবু বলতে চাই, সমস্ত কিছুর পেছনে একটা ব্যাপার মনে রাখতে হবে আমাদের। ভারতের সাহায্য সহযোগিতা, তাদের আমাদের আশ্রয় দেয়া, প্রশ্রয় দেয়া এভরি থিং ওয়াজ ডান ইন দ্যা নেম অব শেখ মুজিব। বঙ্গবন্ধু যদি এই সরকারে বা নেতৃত্বে না থাকতেন আই বিলিভ, আমার সন্দেহ আই ডাউট যে, ভারত এইভাবে আমাদেরকে সাহায্য করতো কি না। হি ক্রিয়েটেড দ্যা গ্রাউন্ড। হি মেড অল দিজ গ্রাউন্ড টু মেক ইট পসিবল। বঙ্গবন্ধুকে সামনে রেখেই এই ঘটনাগুলো ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা ভারতের যে সাহায্য এবং সহযোগিতা পেয়েছি দিজ ইজ অ্যাবস্যুলেটলি ইন দ্যা নেম অব শেখ মুজিব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং এর বিকল্প কোনো চিন্তা করার অবকাশ নেই। হি ইজ সুপ্রীম লিডার অ্যান্ড হি ইজ দ্যা ফাদার অফ নেশন। যার কারণে আমরা ভারতের কাছ থেকে এই সহযোগিতা পেয়েছি। আর একটা কথা বলতে চাই বাংলা ভাষাভাষী ভারতবাসী যারা, তারা এবং যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে তারা বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার মহানায়ক হিসাবেই চেনে এবং একটা নতুন জাতির উন্মেষ ঘটানোর ক্ষেত্রে তাঁর যে অবদান, তাঁর যে চেতনা এটা কিন্তু সর্বস্তরের মানুষের কাছে একটা সাংঘাতিক রকম আবেগঘন বিষয় ছিলো, বিস্ময়করভাবে শ্রদ্ধার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। সুতরাং তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নগুরু, তিনি মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, তিনি জাতির জনক এ সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নাই। এটার বিকল্প কোনো দিন কোনো কিছু ছিলো না। আগামী দিনেও মনে হয় কেউ কোনো কিছু চিন্তা ভাবনা করবে না।

প্র : আপনার এলাকা নওগাঁ কখন মুক্ত হয়?

উ : ২০ ডিসেম্বর ১৯৭১। ঐ দিনই পাকিস্তান আর্মি নওগাঁয় অফিসিয়ালি সারেন্ডার করে। আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন জায়গা থেকে কো-অর্ডিনেট করে এক জায়গায় নিয়ে আসার পর ২০ ডিসেম্বরে তারা নওগাঁ শহর দখল করলো। মুক্তিযোদ্ধারা নওগাঁ শহর চারিদিক থেকে ঘিরে রেখেছিলো কয়েকদিন আগে থেকেই। ফাইনালি পাকিস্তান আর্মি সারেন্ডার করলো ২০ তারিখে। তার আগেই অবশ্য নওগাঁ মুক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু ফরমালি সারেন্ডারের আগে তো মুক্ত বলতে পারবো না। ঘটনাটা একটু বিস্তারিতই বলি। আমি একদল মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ১৬ ডিসেম্বরের আগেই নওগাঁয় যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। সে জন্য আমরা হিলি থেকে গোবিন্দগঞ্জ-বগুড়া হয়ে নওগাঁয় রওনা হয়েছিলাম। ঐ সময় বগুড়ার মহাস্থানগড়ে বিপুলসংখ্যক পাক সেনা ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মোতায়েন ছিলো। ওখানে পাক বাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় বাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর তুমুল যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন উর্ধতন অফিসার মারা যায়। তখন কলকাতা থেকে জরুরী ভিত্তিতে একটা হেলিকপ্টার এসে তার লাশ ওখান থেকে নিয়ে যায়। ঐ পর্যায়ে আমরা মহাস্থানগড়ে গিয়ে পৌঁছি। সেখানে তখনও বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ চলছিলো।

আমরা ওখানে যাওয়ার পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর কমান্ডার আমাদের বললেন যে, ঐ পথে সামনের দিকে বিভিন্ন স্থানে পাক আর্মিরা এখনও অবস্থান নিয়ে আছে। যে অবস্থা, তাতে আরো ৩/৪ দিন লাগতে পারে সামনে অগ্রসর হতে। তাদের হটিয়ে তারপর সামনে এগোতে হবে। এ পথে তোমরা এখন নওগাঁ যেতে পারবে না। তুমি বরং বালুরঘাট ফিরে গিয়ে ওদিক থেকে নওগাঁয় যাওয়ার চেষ্টা করো। তখন আমি ওখান থেকে ব্যাক করে বালুরঘাটে চলে যাই। বালুরঘাটে গিয়ে পরদিন কয়েকজনকে নওগাঁর দিকে পাঠালাম ওদিককার খোঁজ নেওয়ার জন্য। তারা ফিরে এসে বললো যে, ঐ এলাকা দিয়ে পাক আর্মি বা তাদের সহযোগীরা কেউ নেই। তারা সব নওগাঁ শহরে একত্রিত হয়েছে। সারেন্ডার করার জন্যই তারা সব ওখানে একত্রিত হয়েছে।
এই খবর পেয়ে আমি কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে দু’টি মটর সাইকেলে রওনা হলাম ওদিকে। সেদিন ২০ ডিসেম্বর ছিলো। যাওয়ার পথে খবর পেলাম ক্যাপ্টেন গিয়াস আমার জন্য অপেক্ষা করছেন নওগাঁ শহরে। নওগাঁর পাক আর্মি সারেন্ডার করবে। সে জন্য উনি রাজশাহী থেকে এসেছেন। এই খবর পেয়ে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে তাকে খবর পাঠালাম যে, আমার অপেক্ষায় না থেকে সন্ধ্যার আগেই যেন নওগাঁর পাক আর্মিদের তিনি সারেন্ডার করান। আমার হয়তো যেতে দেরি হতে পারে। তখন সব রাস্তাঘাট তো নিরাপদ ছিলো না।
আমি নওগাঁ পৌঁছার পর জানতে পারলাম ক্যাপ্টেন গিয়াস নওগাঁর পাক আর্মিদের সারেন্ডার করিয়ে রাজশাহী ফিরে গেছেন। আমি শহরের কাছে পৌঁছার পর আর মটর সাইকেলে যেতে পারলাম না। ওখান থেকে একদল মুক্তিযোদ্ধা আমাকে তাদের ঘাড়ে চড়িয়ে এস.ডি.ও-র বাংলোতে নিয়ে গেলো। এস.ডি.ও-র বাংলো ওখান থেকে অন্তত: এক দেড় মাইল দূরে ছিলো। তারা আমাকে তাদের ঘাড় থেকে নামতেই দিলো না।

নওগাঁর এসডিও তখন ছিলেন মার্গুব মোর্শেদ। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের এক সময়ের চীফ জাস্টিস বিচারপতি মোর্শেদ তাঁর বাবা। মার্গুব মোর্শেদ তখন তাঁর বাংলোতেই ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হলো। এসডিও-র বাড়ি থেকে আমি ক্যাপ্টেন গিয়াসের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বললাম। তিনি বললেন, আত্মসমর্পণ পিসফুলি হয়েছে। কিন্তু পাক বাহিনীর অফিসারদের যেখানে রাখা হয়েছে সেখানে আপনি যাবেন না। ওখানে পাক বাহিনীর যিনি কমান্ডার তিনি একজন মেজর। সে খুব অ্যাগ্রেসিভ এবং বদমেজাজি। তার নাম মেজর কামাল। সে আপনাকে নামে চেনে। দেখলাম মেজর কামাল আপনার উপর খুব উত্তেজিত। আপনি ওখানে গেলে, বলা যায় না কোনো একটা অঘটন ঘটে যেতে পারে। তাই আপনি ওখানে কাইন্ডলি যাবেন না। আমি বললাম, ঠিক আছে।
যাহোক, আমি ২০ তারিখ রাতেই আবার বালুরঘাটে ফিরে যাই। ওখানে আমাদের তো অনেক কিছু ছিলো। সেগুলো প্যাক আপ করার ব্যাপার ছিলো। রওনা হবার সময় মার্গুব মোর্শেদ বললেন যে, আমিই আপনাকে পৌঁছে দিবো আমার গাড়িতে করে। মার্গুব মোর্শেদ তার গাড়িতে করে আমাকে বালুরঘাটে পৌঁছে দিয়ে ঐ রাতেই আবার নওগাঁ চলে আসলেন। পরদিন থেকেই আমি আমাদের সব কিছু প্যাক আপ করা শুরু করলাম। ২ দিনের মধ্যে সেগুলো প্যাক আপ করা শেষ হলো। এরপর আমি ওখান থেকে সব গুছায় নিয়ে নওগাঁ চলে এলাম।
নওগাঁতে এসেই আমি মুক্তিযোদ্ধদের বলে দিলাম যে, নো মোর কিলিং। রাজাকার বা পাক বাহিনীর সহযোগী যাকেই ধরা হোক না কেন তাকে যেন হত্যা না করা হয়। সে সময় রাজাকার এবং পাক বাহিনীর সহযোগী অনেকে নিজেরাই থানাতে ধরা দিলো। অনেক বিহারীও রাজাকার ছিলো। তাদের জন্য কে ডি স্কুলে ক্যাম্প করা হলো। সেটার দায়িত্ব নিলো ইন্ডিয়ান আর্মি। বিহারী রাজাকার এবং পাক বাহিনীর বিহারী সহযোগীরা ওখানে আত্মসমপর্ণ করতে লাগলো।
এরপর আমাদের দায়িত্ব হলো যে, মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে থাকা অস্ত্রগুলো ফেরত নেয়া। এ ব্যাপারে খুব সজাগ ছিলাম যাতে অস্ত্রগুলো অন্য হাতে না চলে যায়। ঐ চিন্তা থেকে আমি আগেই অস্ত্রগুলো ফেরত নেয়া শুরু করি। অস্ত্র ফেরত নেয়ার সময় প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধাকে একশ’ টাকা দেই। আমাদের কাছে টাকা ছিলো। ফলে, তাদের প্রত্যেককে টাকা দিতে কোনো সমস্যা হয়নি।
মুক্তিযোদ্ধাদের আমি আমার সন্তানের মতো দেখতাম। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের খোঁজ খবর রেখেছি। আমি নিয়মিতই তাদের খোঁজ নিতাম যাতে তাদের কোনো সমস্যা না হয়। যে কারণে মুক্তিযোদ্ধারাও আমাকে এখনও অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখে।

প্র : আপনার এলাকায় শান্তি কমিটির সদস্য, রাজাকার, আল-বদর কারা ছিলো-এদের সম্পর্কে আপনি কিছু বলতে পারবেন কি?

উ : শান্তি কমিটিতে মুসলিম লীগের লোক ছিলো। জামাতের লোকও ছিলো। শামসুদ্দীন শান্তি কমিটির সেক্রেটারি ছিলো। সে ’৭০ সালের নির্বাচনে জামাতের প্রার্থী ছিলো। ১৯৭৫ সালের পরে সে বি. এন. পি. তে যোগ দেয় এবং বি. এন. পি. র নমিনেশনে এম. পি. হয়েছিলো। নওগাঁয় আমার জানা রাজাকার তো অনেক ছিলো। তাদের অনেকে মারাও গেছে। আমার এলাকায় রাজাকাররা সংঘাতিক ক্ষতিকর কিছু করতে পারে নাই। কারণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমার এলাকায় ছিলো পাওয়ারফুল। এমনও ঘটনা আছে, বিচ্ছিন্নভাবে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে বা গেছে তাদের কারো কারো বাবা রাজাকার হয়েছে। ছেলে ফিরে এসে তার বাবাকে মেরে ফেলেছে। নওগাঁতে তাহের বলে এক প্রফেসর ছিলো। সে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে রাজাকার হিসাবে। তার কথা হলো স্বপ্নে তাকে আদেশ করেছে যে, মুক্তিযুদ্ধকে ঠেকাতে হবে। আর ইসলামকে বাঁচাতে হবে। এ রকম অপপ্রচারও ওখানে বিভিন্নভাবে হয়েছে। যদিও এরা আলটিমেটলি ঐভাবে সমাজে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে নাই।

প্র : আপনার এলাকায় পাক বাহিনী বা তাদের দোসরদের অত্যাচার নির্যাতন সম্পর্কে আপনি কি জানেন?

উ : আমার এলাকায় তারা অত্যাচার নির্যাতন করেছে। এটা তারা বিভিন্ন এলাকায় করেছে। নামগুলো এখন আমি ঠিক ওভাবে বলতে পারবো না। তবে নওগাঁ শহর এবং শহরের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় স্বাধীনতার পরে আমরা শত শত মানুষের কঙ্কাল পেয়েছি, খুলি পেয়েছি। মানুষকে হত্যা করে তারা কুপের মধ্যে ফেলে রেখেছে-এরকম বিভিন্ন জায়গায় আমরা গেছি। আমরা সে নর কংকালগুলো উদ্ধার করেছি। তারপরে আরো কতগুলো ঘটনা আছে, যেখানে মানুষকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এই মুহূর্তে আমি ঘটনাগুলো ঠিক বলতে পারছি না। নারী নির্যাতন বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে করেছে। এটা তো অস্বীকার করার কিছু নাই। আমার এলাকায় নারী নির্যাতনের কিছু কিছু ঘটনা আছে। ঘটনা ঘটেছে। সেগুলো বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে। কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বা ঐ জাতীয় কিছু নওগাঁয় ছিলো না।
পাকিস্তান আর্মি যেখানে ছিলো, সেখানে তারা ক্যাম্প বানিয়ে ছিলো। তারা মনে করতো যে, বাংলাদেশের নারীরা তাদের ভোগের সামগ্রী। এটা আনফরচুনেট যে, নারীদেরকে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বিভিন্ন প্ররোচনা দিয়ে। অবশ্য অধিকাংশ জায়গায় আন্ডার প্রেসার বা থ্রেট করে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে। একটা ঘটনা আমি জানি, এটা সাংঘাতিক রকম। আমার নিজের কাছে এটা খুব দু:খজনক মনে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পরে এসে আমি শুনলাম যে, অমুক একটা গ্রামে একটা মেয়ে পাক বাহিনীর হাতে ধর্ষিতা হয়েছে অ্যান্ড সি ওয়াজ ক্যারিং। আমি তার কাছে গিয়েছি। তাকে বলেছি কে এ কাজ করেছে তার নাম বলো। তো সে বলছে, না, আমি তাকে বিয়ে করেছি। বিয়ে করেছো তো তোমার স্বামী কোথায়? বলে চলে গেছে। আমি বলি চলে গেছে মানে! তুমি বিয়ে করেছো কয়দিন হয়? সে বলে বিয়ে করে সে আমার কাছে দু’মাস ছিলো। তারপরে যুদ্ধের পরে সে চলে গেছে। আমি বলি, তাহলে তোমার বাচ্চা যে হবে? বাচ্চা থাকবে আমার কাছে সে বললো। এই বাচ্চা আমার। একদম মুখের উপরে সে এ কথা বলে দিলো। সে যে বললো এটার ব্যাপারে আমার কোনো অভিযোগ নাই। আমি অভিযোগ করবো না। এই ঘটনা বক্তারবুলগা ইউনিয়নের একটা গ্রামের। পরবর্তীকালে সে ঐ গ্রাম থেকে চলে গিয়ে হাপানীয়ার একটা গ্রামে গিয়ে তার আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলো। পরে আমি আর তার খোঁজ খবর নেইনি। তাছাড়া এরকম অনেকেই আছে যারা লজ্জায় কিছু বলতে পারেনি। কারণ সমাজে তো তাদের বাস করতে হবে। দেশ স্বাধীন হয়েছে, পাঞ্জাবিরা নাই, তাদের হাতে তারা অত্যাচার নিপীড়নের শিকার হয়েছিলো, কিন্ত এখন সমাজে তো বাস করতে হবে।
প্র : নওগাঁয় বধ্যভূমি বা গণকবর কোথায় কোথায় ছিলো?

উ : নওগাঁ পৌরসভার মধ্যে ২/৩ জায়গায় ছিলো। পৌরসভার বাইরে মান্দা, পত্মীতলা, আত্রাই, নিয়ামতপুর, বদলগাছিতে ছিলো। আরো কয়েক জায়গায় ছিলো। সব জায়গার নাম আমার মনে নাই।

প্র : মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আপনার পরিচালিত ক্যাম্পে কোনো ফিল্ড হাসপাতাল ছিলো কি?

উ : হ্যাঁ, পতিরাম ক্যাম্পে ফিল্ড হাসপাতাল ছিলো। আমি ওখানে ফুল ফ্লেজেড ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করেছিলাম। সেখানে বেশ কিছু ডাক্তার এবং সাহায্যকারী ছিলো। বগুড়ার ননী গোপাল ডাক্তারও ওখানে ছিলেন। তিনি সে সময় নামকরা ডাক্তার ছিলেন বগুড়ায়।

শরণার্থী ক্যাম্প এবং ফিল্ড হাসপাতালের জন্য বেশ কিছু মহিলা ভলেন্টিয়ারও ছিলো। নীলু নামে এক মেয়ের নাম আমার মনে পড়ছে। সে আমার আত্মীয় হতো। নীলু ভলেন্টিয়ার হিসাবে কাজ করেছে। নাটোরের ২/৩ জন মেয়ে ছিলো। তারা রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে পড়তো। আরো ক’জন মহিলা ছিলো। তারা কে কোন্‌ এলাকার বা তাদের কার কি নাম সেটা এখন আমার মনে পড়ছে না।

প্র : ১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে আপনার জীবনে অনেক ঘটনা ঘটেছে, অনেক কিছু দেখেছেন, অনেক কিছুর সাথে যুক্ত ছিলেন, অনেক কিছু ফেস করেছেন। এই সময় কালে আপনার স্মরণীয় কোনো ঘটনা কি আপনার মনে আছে-যেটা এখনও আপনার স্মৃতিকে নাড়া দেয়?

উ : মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমার অনেক অভিজ্ঞতাই হয়েছে। যেমন বিধবা মায়ের একমাত্র ছেলে যুদ্ধে গিয়ে মারা গেলো। তার নাম নারায়ণ। সে ঘটনাটা আমাকে খুব পীড়া দিয়েছে। এখনও পীড়া দেয়। তখন প্রায় দিনই কোনো না কোনো ঘটনা ঘটেছে। হয়তো বর্ডারে আমাদের ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়ে আহত হয়েছে। আমি খবর পেয়ে ছুটে গিয়েছি। আমি তাদের আহত অবস্থায় নিয়ে এসেছি। অনেকে আমার হাতের উপর হাত রেখে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। এরকম অনেক ঘটনা ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধকালের এসব ঘটনাও আমাকে পীড়া দেয়। আবার সেই স্মৃতিগুলো আমাকে নতুন করে সংগ্রাম করার অনুপ্রেরণাও যোগায়।

যে লক্ষ্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম সে লক্ষ্য তো আজও বাস্তবায়িত হয় নাই। সুতরাং সেটা বাস্তবায়নের জন্য এই সব ঘটনা যখন আমার স্মৃতিপটে আসে তখন এর থেকে নতুন সাহস, শক্তি আমার মধ্যে সঞ্চারিত হয়। আমি সেই সাহস শক্তি নিয়ে আবার মনে করি যে, আমাকে সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে।

আর একটা ঘটনা আমাকে মাঝে মাঝেই পীড়িত করে। নওগাঁতে মামুন বলে একটা ছেলে ছিলো। সে তখন রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে পড়তো। সেই ছেলেকে একটা ক্যাম্পে আমি রিক্রুট করতে বাধ্য হয়েছিলাম ফর হায়ার ট্রেনিং। আমি প্রথমে ঐ ছেলেকে রিক্রুট করি নাই। ওকে রিক্রুট না করে যে সব ছেলেদের রিক্রুট করেছি তাদের ফাইনাল তালিকা করে ঐ ছেলেদের ট্রাকে উঠায়ে দিয়ে আমি খেতে বসছি। এর মধ্যে ঐ ছেলে আমার কাছে যেয়ে কান্নাকাটি শুরু করেছে। বলে যে, আমি মুক্তিযুদ্ধে যাবো। মুক্তিযুদ্ধ করার জন্য আমি আসছি।
আমি তাকে বললাম, তুমি এই ক্যাম্পেই থাকো। এখানেই ট্রেনিং নাও। এখানেই মুক্তিযুদ্ধের সকল কাজে তুমি আমাদের সাহায্য করো। তোমার বয়স হয় নাই। তোমার সেই শক্তি, সাহস এখনও তো অর্জন হয় নাই। কি নিয়ে যুদ্ধ করবা? একটা রাইফেল নিয়ে দৌড়াতে হবে। রাইফেল নিয়ে ট্রেনিং নিতে হবে। সেটা তো তুমি পারবা না। কারণ তোমার বয়স কম ও শরীরের গঠনও সেরকম না। তুমি বাচ্চা ছেলে। তখন তার খুব বেশি হলে ১৫/১৬ বছর বয়সও হবে না। তারপরও সে বলে, না, আমি যুদ্ধে যাবো। কান্নাকাটি শুরু করলো। কান্নাকাটি শুরু করার পরে ওকে আমি ইনক্লুড করে পাঠায় দিলাম হায়ার ট্রেনিংয়ে। ট্রেনিং নিয়ে আসার পরে হি ওয়াজ ইনডাকটেড।
ছেলেটার মান্দা থানায় বাড়ি। বাবার নাম হলো ড. নজরুল ইসলাম। ওর নাম হচ্ছে মামুন। ট্রেনিং নিয়ে আসার পর ইনডাকটেড হয়ে একদিন সে কিভাবে শুনেছে যে, পাঞ্জাবিরা ফেরিঘাট দিয়ে নদী ক্রস করবে। আত্রাই নদী দিয়ে মান্দা থানার ডিভিশন আছে। এই খবর পেয়ে ওরা ৩/৪ জন ওখানে গেছে উইথ গ্রেনেড। ৫/৬টা করে গ্রেনেড তারা নিয়ে গেছে। আর্মির ট্রাকে বা জীপে গ্রেনেড দিয়ে তারা অ্যাটাক করে সেটা উড়িয়ে দেবে। তারা দেখলো সত্যিই আর্মি সেখান দিয়ে পার হচ্ছে। তখন সে গ্রেনেড ছুঁড়ে। মামুন তিনটা গ্রেনেডই ছুঁড়েছিলো। কিন্তু আনফরচুনেটলি তার তিনটার একটাও বার্স্ট হয় নাই। পরে আর্মি তাকে ধরে ফেলে। আর্মি তাকে ধরার পরে ট্রাকের পেছনে রশিতে বেঁধেছে। ওখান থেকে ট্রাকের পিছনে রশিতে বেঁধে টেনে নিয়ে আসছে নওগাঁ টাউন পর্যন্ত। নওগাঁ টাউন ওখান থেকে ১৮ মাইল দূরে। নওগাঁ টাউনে এনে আবার টাউনের মধ্যে ঘুরিয়েছে। যখন ঘোরানো শেষ হয়েছে তখন তার মাথাটুকু বাদ দিয়ে গোটা বডিতে কোনো মাংস ছিলো না। শুধু হাড়। তারপর তাকে তারা ফেলে দিয়েছে। দেশ স্বাধীনের পরে মামুনের নামে আমি কলেজ করেছি, স্কুল করেছি, তার স্মৃতিকে ধারণ করার জন্য।

এই ঘটনাগুলো যখন মনে হয় তখন আমি আমার আবেগ ধরে রাখতে পারি না। ওই অতটুকু একটা বাচ্চা ছেলে! মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তার কি আকর্ষণ। এসব ঘটনা আগামী দিনের মানুষদের প্রেরণার উৎস হিসাবে সমাজে কাজ করবে বলে আমি মনে করি। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসগুলো যদি আমরা লালন করতে পারি, সঠিক ইতিহাস যদি আমরা জনগণের কাছে তুলে ধরতে পারি তাহলে আমাদের আগামী প্রজন্ম প্রেরণা পাবে।

প্র : দেশ স্বাধীনের পর নওগাঁ এলাকার রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট এগুলো কি অবস্থায় ছিলো?

উ : আমাদের অনেক কালভার্ট ও ব্রিজ ধ্বংসপ্রাপ্ত ছিলো। রাস্তাঘাট তখন তো আন্ডার ডেভেলাপ ছিলো। কিন্তু লিংক আপ বিভিন্ন জায়গায় যে রাস্তাঘাট, ব্রিজট্রিজ ছিলো সেগুলো ভাঙা ছিলো। পরে এগুলো রি-কন্সট্রাক্ট করা হয়েছে।

প্র : ১৯৭১ সালে যে লক্ষ্য নিয়ে আপনারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন - আজ এতো বছর পরও সেই লক্ষ্যে কি আপনারা পৌঁছতে পেরেছেন? এ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ণ কি?

উ : আমি বলবো না। আমরা মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য বাস্তবায়নে এখনও সক্ষম হই নাই। সুন্দর জীবন ব্যবস্থা এবং সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধটা করেছিলাম। যে সমাজে মানুষ মানুষের মর্যাদায় বাস করবার অধিকারী হবে। মানুষ অর্থনৈতিক দৈন্যতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাবলম্বী জাতি হিসাবে বসবাস করবে। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মানুষ মুক্তি পাবে। আমরা আসলে এটা বাস্তবায়ন করতে পারি নাই। আমি মনে করি ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্যে দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের যে স্বপ্ন, সে স্বপ্ন থেকে আমরা দূরে সরে গেছি। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ লক্ষ্যভ্রষ্ট করার চিন্তা নিয়েই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিলো। এর মধ্য দিয়েই অ্যান্টি লিবারেশন ফোর্স অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি তাদের লক্ষ্য বাস্তবায়নে সফল হয়েছে।

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর নাম : ড. সুকুমার বিশ্বাস

Popular posts from this blog

“নওগাঁয় মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা”

নওগাঁয় পূর্বের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে,মেলায় অবৈধ ব্যাবসা

দূর্নীতি ছেয়ে আছে নওগাঁ বিটিআরএ