এক জন মুক্তিযুদ্ধা জলিলের সাক্ষাৎকার (পর্ব ১)

নাম : মো: আবদুল জলিল

পিতা : মরহুম ফয়েজউদ্দীন আহমেদ

মাতা : মিসেস জরিনা ফয়েজ

গ্রাম/মহল্লা : চকপ্রাণ, পৌরসভা : নওগাঁ

বর্তমান মহল্লা : ফয়েজ ভিলা, চকদেব, ওয়ার্ড : চকএনায়েত, পৌরসভা : নওগাঁ,

থানা : নওগাঁ, জেলা : নওগাঁ (১৯৭১ সালে রাজশাহী জেলার অন্তর্গত মহকুমা)

শিক্ষাগত যোগ্যতা : বি. এ. (অনার্স), এম. এ. (রাষ্ট্রবিজ্ঞান)

১৯৭১ সালে বয়স : ৩২

১৯৭১ সালে পেশা : ব্যবসা

বর্তমান পেশা : ব্যবসা, চেয়ারম্যান, মার্কেন্টাইল ব্যাংক লি:, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও সংসদ সদস্য, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ







প্র : আপনি ছাত্র রাজনীতির সাথে কিভাবে যুক্ত হয়েছিলেন?



উ : ছাত্রলীগের মেম্বার হলাম ১৯৫৭ সালে যখন আমি রাজশাহী কলেজে ভর্তি হই। সেই সময় আমি ছাত্রলীগের মেম্বার হলাম এবং রাজশাহী কলেজ ছাত্র-সংসদে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলাম সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে। সেই নির্বাচনে আমি সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত হই। অবশ্য ঐ পর্যায়ে আমি রাজশাহী কলেজে বেশিদিন ছিলাম না। এক বছর পর আমি রাজশাহী কলেজ থেকে ফিরে আসলাম এবং নওগাঁ বি. এম. সি. কলেজে ভর্তি হলাম।



প্র : বি. এম. সি. কলেজের পুরো নামটা বলবেন কি?



উ : বশিরউদ্দীন মেমোরিয়াল কলেজ। বশিরউদ্দীন সাহেব আমাদের এলাকার একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। তিনিই উদ্যোগ নিয়ে কলেজটা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরে তাঁর নামেই ঐ কলেজের নামকরণ করা হয়। আমি কলেজে ভর্তি হয়ে সেখানে ছাত্রলীগের প্রথম ইউনিট করলাম। তার আগ পর্যন্ত নওগাঁয় ছাত্রলীগের কোনো কর্মকান্ড ছিলো না। নওগাঁতে তখন ছাত্র ইউনিয়নের প্রভাবটাই খুব বেশি ছিলো। ন্যাপের ২/৩ জন সিনিয়র লিডার ছিলেন। তাঁদের নেতৃত্বে এবং কর্তৃত্বে ছাত্র ইউনিয়নটাই ছিলো নওগাঁর মূল ছাত্র সংগঠন। ছাত্রলীগের কোনো তৎপরতা ছিলো না। ছাত্রলীগের তৎপরতা শুরু হলো ১৯৫৮ সালে নওগাঁ বি. এম. কলেজে ইউনিট করার পর। আমাকে আবার নওগাঁ বি. এম. সি. কলেজ ছেড়ে বগুড়া যেতে হলো নানা কারণে। তারপরে বগুড়া আজিজুল হক কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম তখন সক্রিয়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়লাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের যে বিভাগীয় অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচন হয় সেখানে আমি নির্বাচন করি এবং পর পর দু’বার নির্বাচিত হই।



প্র : এটা কোন্‌ সালে?



উ : এটা একটা হলো ১৯৬০ সালে। আরেকটা হলো ১৯৬১ সালে অর্থাৎ ১৯৬০-৬১ এবং ১৯৬১-৬২। রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচিত সদস্য হিসাবে ছাত্র রাজনীতিতে আমি আরো বেশি সম্পৃক্ত হয়ে পড়লাম। পরবর্তীকালে ১৯৬২ সালে ইস্ট পাকিস্তান ছাত্রলীগের সম্মেলন হলো। সেই সম্মেলনে ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট হলেন কে. এম. ওবায়দুর রহমান আর সেক্রেটারি হলেন সিরাজুল আলম খান। ঐ ক্যাবিনেটে আমি ক্রীড়া সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত হই। পরের বছরে ডাকসুর নির্বাচনে আমি অংশগ্রহণ করি। আমি কমনরুম সেক্রেটারি হিসাবে নির্বাচিত হই। এটা ১৯৬২-৬৩ সালের কথা। সে বছর শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন ডাকসুর ভি. পি. আর কে. এম. ওবায়দুর রহমান ছিলেন জেনারেল সেক্রেটারি। তারপরই তো আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন শুরু হলো। তখনকার প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে আমি অংশগ্রহণ করেছি এবং রাজপথে মিছিল করেছি। পাশাপাশি নওগাঁতে ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। নওগাঁ তখন জেলা হয়নি। মহকুমা ছিলো। মহকুমা ছাত্রলীগ শাখা আমি গঠন করলাম ১৯৬২-তে। মাইনুদ্দীন প্রামাণিককে সভাপতি এবং কাজী রেজাউল ইসলামকে সেক্রেটারি করে আমি নওগাঁ মহকুমা ছাত্রলীগের প্রথম শাখা করলাম ১৯৬২-তে। তারপর থেকেই ওখানে ছাত্রলীগের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৬৩ সালে অনার্স করে ১৯৬৪ সালে এম. এ. পাশ করার পর আমি নওগাঁ বি. এম. সি. কলেজে প্রভাষক হিসাবে জয়েন করার জন্য অ্যাপ্লাই করি এবং নির্বাচিত হই। আমি যেদিন কলেজে জয়েন করতে যাবো ঐদিনই আবার ওখানে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চলছিলো। আমি ভাবলাম যে, ঠিক আছে ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পরে আমি জয়েন করবো। আমি কলেজ মাঠে ঐ ক্রীড়া প্রতিযোগিতাটা দেখছিলাম। তখনই ঢাকা থেকে আসা একটা টেলিগ্রাম আমি ওখানে পেলাম। তাতে লেখা ছিলো আমার ফরেন একচেঞ্জ গ্রান্ট হয়েছে টু গো টু লন্ডন। তখন আমি কলেজে আর জয়েন না করে পরের দিনই ঢাকায় চলে গেলাম। কিছুদিন পরে অর্থাৎ ১৯৬৫ সালের মার্চে আমি বিলেত (লন্ডন) গেলাম ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য। ওখানে গিয়ে আমি লিংকন ইন-এ ভর্তি হলাম। সেখানে আমি পড়ালেখা করার সময় ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু বিলেত গেলেন। তখন উনি আমাকে এবং আরো কয়েকজনকে বললেন যে, আমাদের দেশে যাওয়া প্রয়োজন। তারপরে তো দেশে আসলাম। দেশে এসে সম্পৃক্ত হলাম রাজনীতিতে এবং তখনকার আন্দোলন সংগ্রামে।



প্র : আপনি ফিরে আসলেন কোন সময়ে?



উ : ১৯৬৯ সালে। মাসটার কথা ঠিক মনে নাই। খুব সম্ভব জুলাইয়ের দিকে হবে। বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়েছিলেন ফেব্রুয়ারিতে। মার্চে লন্ডন গেলেন এবং জুন-জুলাইয়ের দিকে মনে হয় ফিরে আসলাম। আসার পরে আমি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লাম এবং তখনকার সমস্ত আন্দোলন কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত হলাম। তারপরে তো পাকিস্তানি শাসকরা নির্বাচন দিতে বাধ্য হলো ১৯৭০ সালে।



ঐ নির্বাচনে প্রভিনসিয়াল অ্যাসেম্বলিতে বঙ্গবন্ধু আমাকে নির্বাচন করতে বললেন। তিনি আমাকে বললেন, তোমাকে ইলেকশন করতে হবে। আমি তাঁকে জানালাম যে, আমি ইলেকশন করবো না। তো উনি আমাকে বললেন কেন? আমি বললাম যে দু’টা কারণ। একটা হচ্ছে যে, আমি লন্ডনের রিটার্ন টিকিট নিয়ে এসেছি। ইলেকশনের পরেই আমি চলে যাবো। আর ৮/৯ মাস পর আমার ব্যারিস্টারি পড়া কমপ্লিট হবে। আমি ব্যারিস্টারি পড়াটা কমপ্লিট করবো। আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, আমি ছাত্রজীবন শেষ করে চলে গেছি বিদেশে। ছাত্রজীবনে আমি ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। লোকাল পলিটিঙে আমার সম্পৃক্ততা ছিলো না। এই সময় যদি আমি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি হয়তো আমি জিতবো। কিন্তু স্থানীয় আওয়ামী লীগের যারা নেতা কর্মী আছেন তাঁরা বলবেন যে, এই লোকটার আওয়ামী লীগের স্থানীয় সাংগঠনিক কর্মকান্ডে বা রাজনীতিতে কোনো কনট্রিবিউশন নাই। তারপরও সে উড়ে এসে আমাদের উপর জুড়ে বসলো। আমার গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে আমি প্রথমেই প্রশ্নের সম্মুখীন হবো। এই কারণে আমি এখন নির্বাচন করতে চাই না। আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম, আমি কাজ করবো। কাজ করে আমি স্থানীয় কর্মীদের সাথে একাত্ম হওয়ার পরে ভবিষ্যতে ইলেকশন করবো। এ কথা বলার পরও ইলেকশনে অংশগ্রহণ করার জন্যে বঙ্গবন্ধু আমাকে আরো কয়েকবার বললেন।



পরে ওবায়দুর রহমান, মণি ভাই (শেখ ফজলুল হক মণি), তারপরে সিরাজুল আলম খান, মাযহারুল ইসলাম বাকী, তারপর তখন ছাত্রলীগের সেক্রেটারি ছিলো আমার বন্ধু আবদুর রাজ্জাক-এরা সবাই মিলে আমাকে খুবই চাপাচাপি করলো। তাঁরা সবাই আমাকে বললো যে, আমরা সবাই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি, তুমিও করো। আমি বললাম যে, আমি ইলেকশন করবো না। পরে বঙ্গবন্ধু আমাকে আবার ডাকলেন এবং বললেন যে, তুমি আবার চিন্তা করো। আমি লাস্ট ডেট পর্যন্ত অপেক্ষা করবো। তোমার হ্যাঁ বা না এর পরে আমি ওখানে প্রার্থী দেবো। আই অ্যাম গ্রেটফুল টু মাই লিডার, উনি পাঁচ দিন অপেক্ষা করেছিলেন আমার জন্য। আমি প্রথম থেকেই না বলে আসছিলাম এবং পাঁচ দিন পর আমি চূড়ান্তভাবে জানিয়ে দিলাম যে, আমি আমার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছি না। তখন উনি অন্য একজনকে নমিনেশন দিলেন। কিন্তু আমার দায়িত্ব হলো যে, আমার এলাকায় যারা ন্যাশনাল এবং প্রভিনশিয়াল অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়িয়েছেন তাদের সবাইকে পাশ করিয়ে নিয়ে আসা। ১৯৭০ সালে আমি নওগাঁ মহকুমার নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছি। ঐ দায়িত্ব নিয়ে আমি নির্বাচনী কর্মকান্ড কো-অর্ডিনেট করার পাশাপাশি প্রচারণাও চালিয়েছি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নওগাঁর সব আসনেই আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা বিজয়ী হয়। তারপর নির্বাচনের পরের ইতিহাস তো সবাই জানে। পাকিস্তানি শাসকরা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা না দেওয়ায় দেশে আন্দোলন শুরু হলো। আমি সেই আন্দোলনের সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলাম।



প্র : ১৯৭০ সালে যে নির্বাচন হলো তাতে নওগাঁয় ক’টা আসন ছিলো এবং সে আসনে কারা কারা নির্বাচিত হয়েছিলেন?



উ : নওগাঁতে এম. এন. এ. পদে আসন ছিলো ৩টা। তার একটাতে দেওয়ান আজিজার রহমান, একটাতে আতিয়ার রহমান তালুকদার, আর একটাতে এমডি. বায়তুল্লাহ সাহেব নির্বাচিত হন। বায়তুল্লাহ সাহেব পরে ডেপুটি স্পীকার হয়েছিলেন। আর প্রভিনসিয়াল অ্যাসেম্বলিতে গিয়াসউদ্দীন সরদার, ক্যাপ্টেন ইসমাইল হোসেন চৌধুরী, ইমাজউদ্দীন প্রামাণিক, আজিজুল ইসলাম খান, কাজিমদার ওয়াসিমউদ্দীন আহমেদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। সবগুলোতেই আমরা জিতেছিলাম, আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিজয়ী হয়েছিলো।



প্র : ১৯৭০ সালের নির্বাচন পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে আপনি কি জানেন-আপনার সে সময়ের অভিজ্ঞতার কথা বলবেন?



উ : নির্বাচনের পর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে তো পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসকরা ক্ষমতা হস্তান্তর করে নাই। সেটা তো একটা ইতিহাস এবং সেটা আমরা সবাই জানি। তখন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মতো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মানে আজকের বাংলাদেশে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন হচ্ছিলো। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। সেই অসহযোগকে বাস্তবায়িত করার জন্য আন্দোলন, মিছিল, মিটিং যা করার তার সবগুলোই আমরা আমাদের নওগাঁ মহকুমায় করেছি। শেষ মুহূর্তে যখন কোনো কিছুতেই পাকিস্তানিরা আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করছিলো না তখন অর্থাৎ অসহযোগ আন্দোলনের চরম মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার লক্ষ্যে জাতিকে ডাক দিলেন এবং আমাদেরকে সেভাবেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। দেশ এবং জাতির এক ক্রান্তিকালে উনি সেই ডাক দিলেন। ওনার সেই ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি প্রত্যেক এলাকায় ‘সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করার কথা বললেন।



সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর নাম : ড. সুকুমার বিশ্বাস

সাক্ষাৎকার গ্রহণের তারিখ : অগাস্ট ১১, ২০০৫ ও অগাস্ট ৩১, ২০০৫
মূল প্রবন্ধ: প্রফাইল-বাংলা

Popular posts from this blog

“নওগাঁয় মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা”

নওগাঁয় পূর্বের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে,মেলায় অবৈধ ব্যাবসা

দূর্নীতি ছেয়ে আছে নওগাঁ বিটিআরএ