কেমন আছেন গ্রামবাসী?

সাদামাটা চোখে দেখা যায়, বিশ্বের বড় বড় দাতাগোষ্ঠী তথা উন্নত বিশ্ব আমাদের জন্য অনেক কিছুই করছে। সবই আমাদের ভালোর জন্য। কিন্তু সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে, তারা কি সত্যি সত্যিই আমাদের কিংবা আমাদের মতো স্বল্পোন্নত দেশের কল্যাণের জন্য কিছু করে? এ যাবৎকালের অভিজ্ঞতা তো তা বলে না। কতই না প্রতিশ্রুতি শুনি উন্নত বিশ্বের। আমাদের কল্যাণে তারা কতই না ছাড় দেবে? আর এসব কথা শোনা যায় আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোতে, যেখানে উন্নত-স্বল্পোন্নত-অনুন্নত সব এক হয়। দরিদ্রদের প্রতি করুণা বর্ষণের প্রশ্নে কারোই তুলনা নেই। এই যে বছরের ৩৬৫ দিনই কোনো না কোনো দিবস পালন হয়, এর মধ্যে কোনোটি এ দেশে উদযাপিত হয়, আবার কোনোটি হয় না। আমার জানা মতে, ৯৮টি আন্তর্জাতিক দিবস রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দিবস, যেগুলোর বাতাস এ দেশেও পেঁৗছতে শুরু করেছে। দিবস পালন হোক_ এ ব্যাপারে আমার কোনো মন্তব্য নেই। কিন্তু কথা হচ্ছে, সব দিবস কি আমাদের জীবনে কোনো প্রভাব ফেলে? নিশ্চয়ই নয়। কোনো কোনো দিবসের তাৎপর্য রয়েছে; সব ক'টির নয়। দিবসগুলোতে যেসব বড় বড় বুলি আমরা উন্নত বিশ্ব তথা দাতা সংস্থা থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে শুনতে পাই, দিবস পেরিয়ে গেলে কিন্তু এর কোনো প্রতিফলন দেখতে পাই না। যাহোক, আমার এ প্রসঙ্গ অবতারণার কথা নয়। শিরোনামের সঙ্গে এসব কথার প্রাসঙ্গিকতা নেই। কিন্তু কথাগুলো আমার মনে হলো পুরনো একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ২০০৭ সালে চ্যানেল আইতে আন্তর্জাতিক মা দিবসে বেশ সাড়ম্বরে ক্যাম্পেইন করা হয়েছিল বড় একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায়। সেখানে এসএমএসের একটি প্রতিযোগিতা ছিল। কথা ছিল, ৬০ ক্যারেক্টারের মধ্যে মা সম্পর্কে লিখে পাঠাতে হবে মোবাইলে। অসংখ্য এসএমএস এসেছিল। এর মধ্যে যে এসএমএসটি প্রথম হয়েছিল, তাতে লেখা ছিল_ 'তোদের কত সাহস! মায়ের কথা ৬০ ক্যারেক্টারে লিখতে বলিস!' বিচারকদের রায়ে এই এসএমএসটিই প্রথম হয়েছিল। সমকালের আজকের এই সংখ্যায় লেখার জন্য নাসির আহমেদ আমাকে ফোনে জানিয়েছিলেন, ৫০০ থেকে ৬০০ শব্দের মধ্যে লিখতে হবে_ 'কেমন আছেন গ্রামের মানুষ?' ফোনে সেই এসএমএসটির মতোই উত্তর দিলাম নাসিরকে। ১৫ কোটি মানুষের এই দেশটির সিংহভাগই গ্রামের মানুষ। যারা আমাদের খাদ্য উৎপাদনের মূল নিয়ামক, যারা আমাদের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি, তাদের সম্পর্কে ৭০০ শব্দে লেখার সাহস আমার নেই। সব ক্ষেত্রেই গ্রামের মানুষের অবস্থানকে সংকুচিত করা হচ্ছে। অল্প কিছু জায়গা নিয়ে শহর। দেশের ১১ কোটিরও বেশি মানুষের বসবাস গ্রামে। তাদের ভালো-মন্দের খবর এত কম কথায় কীভাবে বলি? অবশেষে এক হাজার শব্দ বরাদ্দ পেলাম। কিন্তু এরই মধ্যে আমার সাড়ে ৩০০ শব্দ পার হয়ে গেছে। গড়পড়তায় সেই ৬০০ শব্দের বাঁধা কাঠামোর মধ্যেই এসে পড়লাম।

গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের ৩৯ বছরে পদার্পণ করেছি আমরা। আজ ২০১০ সাল। আমাদের স্মরণ করার যথেষ্ট যৌক্তিকতা রয়েছে যে, এ দেশের মানুষ কেন যুদ্ধ করেছিল? গ্রামের মানুষ কোন বিশ্বাস ও যুক্তিতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল? মূল যে কারণ ছিল, তা হচ্ছে মৌলিক অধিকারগুলোর বাস্তবায়ন। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার নিশ্চয়তা আসবে স্বাধীন ক্ষেত্র থেকে। তার অধিকার বাস্তবায়নের লক্ষ্য থেকেই পরিচালিত হবে দেশ। আর এই স্বপ্নটি দেখতে পার করতে হয়েছে অনেক বছর। পেরিয়ে আসতে হয়েছে অনেক প্রথার শাসন-শোষণ, বিদ্রোহ, প্রতিবাদ, ঔপনিবেশিক দীর্ঘ অধ্যায় এবং বর্গি, হানাদার। এই দেশ, মাটি, প্রকৃতি ও সম্পদের ভেতর মাটিঘেঁষা মানুষগুলো কোন ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর? সেদিনকার ২০ বছরের তরুণ মুক্তিযোদ্ধা আজ অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ এক বৃদ্ধ কৃষক। শাহ আলী নামে এক কৃষকের কথা বলছি। গল্প নয়, একেবারে সত্যি। শাহ আলীর জন্ম ১৯৫১ সালে সিরাজগঞ্জ সদরের ছোনগাছা ইউনিয়নের গোপীরপাড়া গ্রামে। বাবা আহাদ বক্সের ৮ সন্তানের মধ্যে শাহ আলী ছোট। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছেন গ্রামের স্কুলে। মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। কৃষক পরিবারের সন্তান হিসেবে পুরাদস্তুর কৃষক। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া সামান্য জমিতে চাষবাস। বয়স যা-ই হোক, হতাশাচ্ছন্ন চিন্তায় জীবনের যেন শেষ প্রান্তে এসে পড়েছেন। প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির হিসাব কষার সময় এসে গেছে এখন। বাবা আহাদ বক্সের ছিল ১২ বিঘা আবাদি জমি। তখন তার বাড়িটি ছিল মাত্র ২৭ শতাংশ জমির ওপর। গত ৪০ বছরে আহাদ বক্সের বংশলতিকায় যোগ হয়েছে ৪৫টি মুখ। মানুষ বৃদ্ধির কারণেই বাড়িটির জমির আয়তন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০ শতাংশে। তিনটি প্রজন্ম এসেছে। ঘর বেড়েছে, খাদ্যের মুখ বেড়েছে, কিন্তু বাড়েনি চাষের জমি।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৯০ লাখ। তিন দশকে, অর্থাৎ ২০০০ সালে এই জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ কোটিতে। বর্তমানে ধরা হয় ১৫ কোটি। '৭১-এ পরিবার ছিল প্রায় ৯০ লাখ। এখন পরিবারের সংখ্যা ১ কোটি ৯০ লাখ। একান্নবর্তী পরিবারগুলো সময়ের প্রয়োজনেই ভেঙে খণ্ড খণ্ড হয়ে গেছে। যদিও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৭০ দশকের তুলনায় দশমিক ৫৮ ভাগ কমেছে, তারপরও ভূমির আয়তনের তুলনায় এই জনসংখ্যার হার অত্যধিক। ভূমির হিসাবে বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ। এখন প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৯০০ থেকে ৯৫০ জন। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গত ২২ বছরে গ্রামাঞ্চলে জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৩ কোটি।

বর্তমানে মোট গ্রামীণ জনসংখ্যা ১১ কোটি। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ, অর্থাৎ ৮৩ শতাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাক্কলন অনুযায়ী, গ্রামাঞ্চলের ৪৭ দশমিক ১ শতাংশ লোক দারিদ্র্যসীমা এবং ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ লোক চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। বর্তমানে মোট জনগোষ্ঠীর ২২ শতাংশ ভূমিহীন, অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ৩ কোটি মানুষের কোনো ভূমি নেই। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশে অর্ধলক্ষাধিক বেসরকারি সংগঠন ও সংস্থা বা এনজিও গড়ে উঠেছে, যারা মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর কথা বলে হাজার হাজার কোটি টাকার কারবার করেছে। বাইরে থেকে সাহায্য এনেছে, অংশীদারী উন্নয়ন তহবিল এনেছে, কিন্তু তা কতটুকু উন্নয়নে ব্যয় হয়েছে, গ্রামের মানুষ জানে না। হিসাবটি এত বড় এবং বিচ্ছিন্ন যে, কোনো দফতরের কাছেও এর রেকর্ড নেই। অথচ টাকা ঘুরছে দেশের মধ্যেই, ব্যবসা চলছে গ্রামের মানুষকে পুঁজি করে। গ্রামের দরিদ্র মানুষের শ্রেণী বিভাগ হচ্ছে_ দরিদ্র থেকে হতদরিদ্র, অতি দরিদ্র ইত্যাদি। অথচ এনজিওগুলো প্রাথমিক উদ্দেশ্য হিসেবে যা উলেল্গখ করে, তা হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচন। দারিদ্র্যের সংখ্যা কমানো নিয়ে তারা নানা রকম ইশতেহার দেয়। নানা রকম লোক দেখানো কর্মসূচিও নেয়। কার্যত দারিদ্র্যের হার আরও বাড়ে। ধরন পাল্টায় শুধু। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একসময়কার চরম দরিদ্র, যার কোথাও ঋণ ছিল না, সে এখন আগের মতোই দরিদ্র আছে; সেই সঙ্গে চেপে বসেছে ঋণের বোঝা, যে বোঝা বহনের শক্তি তার নেই। এভাবেই দারিদ্র্য বাড়ছে। যদিও মানব উন্নয়ন সূচকে আমাদের দারিদ্র্য অত্যন্ত ধীর গতিতে কমছে বলে উল্লেখ করা হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবিক অর্থে আমাদের আর্থ-সামাজিক দারিদ্র্য এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বিত্তহীন হওয়ার হার দিনের পর দিন বাড়ছে।
গ্রামের কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীই যে শক্তির আধার, এ বিষয়টি আজও বুঝে ওঠার চেষ্টা করেনি রাষ্ট্র পরিচালনাকারীরা। আজও আমরা ভেবে দেখি না, গ্রামের উৎপাদক শ্রেণী যদি ফসল না ফলাত, তাহলে এই ১৫ কোটি মানুষের খাদ্যের জোগান হতো না। গ্রামের এই মানুষগুলো কেমন আছে? কৃষক ও মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলীর যে গল্পটি বললাম, এটা সারা বাংলাদেশের চিত্র। গ্রামীণ জীবনে কোনো কিছু যুক্ত হয়নি; শুধু হারিয়েছে আর হারিয়েছে। সময়ের স্রোতে মানুষের আন্তরিকতা এবং মানবতাও হারিয়ে গেছে অনেক ক্ষেত্রে। নদী তীরবর্তী এলাকায় ভাঙন কবলিত ভূমিহীন ও দরিদ্রের সংখ্যা বাড়ছে, উত্তরের অভাবপীড়িত মানুষ জমি-জিরাত হারিয়ে কিংবা বিক্রি করে শহরের বস্তিতে আশ্রয় খুঁজছে। গ্রামের মানুষের মূল জীবিকা কৃষি হলেও এখন কৃষির অভিভাবক তারা নয়। একসময়কার অধিকাংশ ভূমি মালিক বা কৃষক এখন বর্গাচাষি এবং কৃষিশ্রমিকে পরিণত হয়েছে। কৃষি চলে যাচ্ছে অর্থশালী শহুরে উদ্যোক্তাদের হাতে, যারা গ্রামের কৃষকদের মাথার ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে, আর কৃষকরা সহজেই মেনে নিচ্ছে তাদের নিয়তি।

এর ভেতরেই শত প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে যারা ভালো করছে, তাদের দেখলে উজ্জীবিত হই। মনে হয়, এই সংগ্রামসফল মানুষগুলোই আমাদের সঠিক স্বপ্ন দেখাতে পারে। তারা অনেক দরিদ্র সংগ্রামী মানুষের নির্দেশক হিসেবে কাজ করছে। গ্রামের দরিদ্র মানুষ দেশের জন্য তার সবটুকু সাধ্য বিনিয়োগ করতে পারে, ত্যাগ করতে পারে একান্ত নিজস্ব স্বার্থ, ভাবতে পারে_ দেশ বেঁচে থাক, দেশের মানুষ বেঁচে থাক। এই ভাবনাটি কি আমরা শহুরেরা ভাবতে পারি? অথচ গ্রামের মানুষের পাশে দাঁড়াই না কেউ; কিন্তু তাদের জন্য সাহায্য-সহযোগিতা নেই, গ্রামমুখী বিনিয়োগ নেই। বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তারা শুধু শহরের দিকেই ঝুঁকছে। এ এক দারুণ বঞ্চনা।

লেখাটি শুরু করেছিলাম অপ্রাসঙ্গিক একটি প্রসঙ্গ দিয়ে। আমাকে বেঁধে দেওয়া শব্দ কাঠামো অনেক আগেই অতিক্রম করেছি। কিন্তু গ্রামের কুশল হয়তো এখনও বলা হয়নি। সহজ করে বলি, আমরা উন্নয়নশীল দেশ। আমরা এখন আক্রান্ত। গোটা বাংলাদেশটিই যেহেতু একটি গ্রাম, সেই গ্রামটিই এখন আক্রান্ত। উন্নত বিশ্ব জানে, জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে কোথায় পেঁৗছেছে এই দেশটি। আর গ্রামপ্রধান তথা কৃষিপ্রধান বাংলাদেশকে বাঁচানোর কলকাঠি উন্নত বিশ্বের হাতে। কার্বন নির্গমন কমাতে হবে। ১৯৯৭ সালের ১১ ডিসেম্বর গৃহীত কিয়োটো প্রটোকলের শর্তগুলো মানেনি আমেরিকাসহ শিল্পোন্নত দেশগুলো। কার্বন নির্গমন কমায়নি তারা, বরং বাড়িয়েছে। ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে কোপ-১৫ নামের জলবায়ু সম্মেলনে দেওয়া প্রতিশ্রুতি শিল্পোন্নত দেশগুলো কতটুকু মানবে, তা এখনই প্রশ্নসাপেক্ষ। কথা না রাখার সংস্কৃতিতে উন্নত বিশ্ব অনেক বেশি অভ্যস্ত, যেটা আমাদের গ্রামের মানুষ জানে না। আর জানে না বলেই আক্রান্ত হয় তারাই। তৃতীয় বিশ্বের গ্রামপ্রধান সব দেশেরই একই অবস্থা। এখন প্রশ্নটি আপনাকেই করছি_ কেমন আছেন গ্রামের মানুষ?
লেখক : কৃষি উন্নয়ন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই (সুত্র, সমকাল, ০১/০১/২০১০)

Popular posts from this blog

“নওগাঁয় মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা”

নওগাঁয় পূর্বের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে,মেলায় অবৈধ ব্যাবসা

দূর্নীতি ছেয়ে আছে নওগাঁ বিটিআরএ