এক জন মুক্তিযুদ্ধা জলিলের সাক্ষাৎকার (পর্ব ৩য়)

প্র : বোমা কি বিহারীরা বানাচ্ছিলো?



উ : হ্যাঁ, বিহারীরা। তারপরে আমরা কনফার্ম হয়ে গেলাম যে, বিহারীরা হয়তো কোনো ষড়যন্ত্র করছে। এরকম অনেক ঘটনা তখন ঘটেছিলো। এখন সব ভুলে গেছি। যাহোক, তারপর ওদেরকে (বিহারীরা) নিয়ে আমি বসলাম। তাদের বললাম যে, দেখো আমাদের ম্যুভমেন্টের সঙ্গে এই ঘটনার কোনো সম্পর্ক নাই। এটা পারসোনাল একটা ব্যাপার। ইনসিওরেন্স ক্লেম পাওয়ার আশায় সে এটা করেছে। এটার সঙ্গে আমাদের ম্যুভমেন্টের বা বিহারী বাঙালির কোনো সম্পর্ক নেই। তারপর ঐ ব্যাপারটা তখন মিটে গেলো।



তারপর থেকে আমাদের কর্মসূচি বা আন্দোলন সংগ্রাম এগিয়ে নিচ্ছি। ২৬ মার্চের পরে আমরা সংগ্রাম পরিষদের অফিস করলাম কে. ডি. স্কুলে। ওখানে আমরা ২৪ ঘন্টা থাকতাম। আমরা যুবক ছেলেপেলেদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করলাম। ২৬ তারিখে মেজর নজমুল হক বললো যে, রংপুর থেকে বগুড়ার দিকে পাক আর্মি আসছে। ওদের রাস্তায় কোথাও ব্লক করা দরকার। এরপর উনি বললেন যে, আমি কিছু ছেলেকে এক্সপ্লোসিভ ট্রেনিং দেই। আপনি কিছু ছেলে দেন। আমি ট্রেনিং দিয়ে ওখানে পাঠাই। রাস্তায় কোথাও অন্তত: একটা ওবস্ট্রাকশন দিতে পারলে অন্তত ৭ দিন ওরা ওখানে বন্ধ হয়ে থাকবে। ওরা ফারদার ক্লিয়ারেন্স ছাড়া আর ম্যুভ করবে না। তো আমরা ১৬ জন ছেলেকে মেজর নজমুলের মাধ্যমে ট্রেনিং দেওয়াই। মূলত: গ্রেনেড কি ভাবে ছুঁড়তে হয় সেটা শেখানো হয়। গ্রেনেড ছোঁড়া শিখিয়ে তাদের গ্রেনেড দিয়ে আমরা পাঠিয়ে দিলাম বগুড়ায়।



প্র : এটা কয় তারিখের দিকে?



উ : এটা ২৬ মার্চের পরে। ২৭ কিংবা ২৮ তারিখের দিকে হবে।



প্র : নওগাঁ মহকুমার পুলিশ প্রশাসন এবং সরকারি প্রশাসন তখন কাদের নিয়ন্ত্রণে?



উ : তখন গোটাটা আমাদের সংগ্রাম পরিষদের কন্ট্রোলে। আমরা যেভাবে কমান্ড করেছি তারা সে ভাবেই আমাদের সহযোগিতা করেছে।



প্র : আর্মস তখন কি আপনাদের নিয়ন্ত্রণে?



উ : হ্যাঁ, বাঙালি ইপিআররা আমাদের নিয়ন্ত্রণে। তাদের আর্মসও।



প্র : তখন পুলিশের কাছেও তো আর্মস ছিলো?



উ : তখন পুলিশরা তো আমাদের সঙ্গেই ছিলো। তারাও আমাদের কমান্ডে ছিলো আর কি। যাহোক, আমরা ১৬ জন ছেলেকে পাঠালাম। বগুড়ার শিবগঞ্জ এলাকায় রংপুর-বগুড়া সড়কে পাক আর্মির সাথে তাদের একটু ক্লাস হলো। তারপরে ওরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো। আমাদের একজন ছেলে ফিরে আসলো না। সে হলো মনির। সে নওগাঁ ডিগ্রী কলেজের শরীরচর্চা শিক্ষক ছিলো তখন। আমরা উদ্বিগ্ন হলাম যে, আমাদের একটা ছেলে লস্‌ হয়ে গেলো। অবশ্য চারদিন পরে সে আবার ফিরে এসেছিলো। সে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিলো। এর মধ্যে খবর আসলো যে, রাজশাহীতে পাক সেনা বাহিনীর একটা ইউনিট আছে। এরা রাজশাহী শহর দখল করার চেষ্টা করছে। তখন আমরা ওদেরকে অ্যাটাক করার জন্য ক্যাপ্টেন গিয়াস সাহেবের নেতৃত্বে ই.পি.আর এবং আমাদের কিছু ছেলেকে, যাদের অস্ত্রের ট্রেনিং দেয়া হয়েছিলো আগে, তাদেরকে আমরা পাঠালাম রাজশাহীতে।



প্র : তাদের রাজশাহী কয় তারিখের দিকে পাঠালেন?



উ : এটা বোধহয় এপ্রিলের ৩/৪ তারিখের দিকে। পাঠানোর পরে ওখানে তাদের সঙ্গে পাক বাহিনীর এনকাউন্টার হয়।



প্র : এনকাউন্টারটা কোন জায়গায় হয়েছিলো?



উ : রাজশাহীতে তখন সেনাবাহিনীর যে ক্যান্টনমেন্ট ছিলো তার কাছাকাছি। রাজশাহী ক্যান্টনমেন্টে ঢোকার চেষ্টা করেছিলো আমাদের ফোর্সটা স্থানীয় পাবলিকদের সঙ্গে নিয়ে। ওখানেই এনকাউন্টারটা হয়। তারপরে আমাদের কাছে খবর আসলো যে, রাজশাহী আমাদের ফোর্স দখল করে নিয়েছে। তখন অবশ্য নানারকম পাল্টাপাল্টি খবর আসছিলো। প্রথম খবর আসলো, আমাদের ফোর্স রাজশাহী দখল করে নিয়েছে। আবার পরে খবর আসলো যে, রাজশাহী আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। এরকম সব খবর টবর আসছে। এর মধ্যে আমরা ঠিক করলাম যে, আমাদের নাটোরের দিকে যাওয়া দরকার। নাটোরের এই রোডটা ব্লক করা দরকার। তখন আমি এবং মেজর নজমুল হক কিছু ইপিআর ফোর্স নিয়ে গেলাম নাটোরের দিকে। কিন্তু নাটোরে আমরা ঢুকতে পারলাম না। নাটোরে যাওয়ার আগেই আমরা দেখলাম যে, পাকিস্তান আর্মি রাজশাহী থেকে ঐদিকে মার্চ করেছে। আবার ঢাকা থেকে আসা কিছু পাক আর্মিও স্পীড বোটে যমুনা নদী পার হয়েছে। তারা পাবনা হয়ে ওদিকে রওনা হয়েছে। সেই সময় রংপুর থেকে বগুড়া হয়ে এনসারকেল এরিয়াটায় বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে আমরা পাক আর্মির সাথে ফাইট করছি। আমরা বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছি আবার নওগাঁ আসছি। নওগাঁর টোটাল কন্ট্রোলটা কিন্তু তখনও আছে আমাদের।



১৫ এপ্রিল রাতে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমাদের ফ্যামিলিটা শহর থেকে সরিয়ে দেওয়া দরকার। এছাড়া আরো সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যে, বায়তুল্লাহ সাহেবকে আমরা কলকাতা পাঠাবো যে আসলে ওখানে কি হচ্ছে সেটা জানার জন্য।



প্র : তখন কি আপনাদের অন্য কারো সাথে বা অন্য জেলার সাথে যোগাযোগ ছিলো না?



উ : না, কারো সাথে তেমন কোনো যোগাযোগ নেই। যা করার আমরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে করছি। আমরা একদিন খবর পেলাম যে, আমাদের পাশের জয়পুরহাট দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা পাবনার ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সাহেব কলকাতা গেছেন। এটুকু খবর আমাদের কাছে আসলো। কিন্তু তার কনফারমেশন কিছু নাই।



যাহোক, এপ্রিলের ১৫ তারিখে মেজর নজমুল হকের সাথে আমার কথা হলো। তিনি আমাকে বললেন যে, ভাই, ইট ওয়াজ হাই টাইম, আপনাদের ফ্যামিলিগুলোকে একটু নিরাপদ জায়গায় পাঠানো। আমি বললাম যে, তারা নিরাপদ আর কোন জায়গায় যাবে? পরে অবশ্য বললাম, ঠিক আছে, আপাতত: তাদের টাউন থেকে কোথাও না হয় পাঠিয়ে দেই। তারপর ঐ দিনই টাউন থেকে আমার ফ্যামিলি, মেজর নজমুল হকের ফ্যামিলি এবং বায়তুল্লাহ সাহেবকে নিয়ে পত্মীতলায় আমাদের পার্টির নেতা কাজী আবদুল মজিদের বাড়িতে গেলাম। তারপর সেখান থেকে বায়তুল্লাহ সাহেবকে ইন্ডিয়া পাঠিয়ে দিলাম। পাঠিয়ে দিয়ে আমরা ভোর বেলা মানে ১৬ এপ্রিলের ভোর বেলা নওগাঁ ব্যাক করলাম। ব্যাক করে আমি কে. ডি. স্কুলের খেলার মাঠে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি তখন।



প্র : ওখানে তখন আর কারা আপনার সাথে ছিলো?



উ : আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা ছিলো, আমাদের ছেলেপেলেরা ছিলো, আমাদের সংগ্রাম পরিষদের সব ছিলো। কারণ আমাদের সবগুলো ক্যাম্প তো ওখানেই করা হয়েছিলো। ওখানেই সব আছে। ২৪ ঘন্টা তারা ওখানেই থাকে অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে। ওখান থেকে কো-অর্ডিনেট হচ্ছে। পুরো মহকুমার সব কিছু কো-অর্ডিনেট হচ্ছে ওখান থেকেই।



যাহোক, আমি সারারাত জাগা। ভোর বেলা পত্মীতলা থেকে এসে একটু শুয়েছি, একটু তন্দ্রার ভাব এসেছে। সকাল সাড়ে আটটার দিকে হঠাৎ হৈ চৈ। আমার তন্দ্রা ভেঙে গেলে জিজ্ঞাসা করলাম কি হলো, কি ব্যাপার? শুনি যে, মোরশেদ নামে একজন কিছু লোকজন সঙ্গে নিয়ে এসে ওখানে হাঙ্গামা শুরু করেছে। মোরশেদ ভাসানী ন্যাপ করতো। সে আমজাদ, টামজাদ নামে কতগুলো ক্রিমিনালকে সঙ্গে নিয়ে নওগাঁ উকিল বারের পাশে এখন যে শহীদ মিনার আছে, ওটা পরে করা হয়েছে, ওখানে দাঁড়ায়ে বলছে যে, বাজার থেকে কিছু টাকা তোলা হয়েছিলো ফর দিস ম্যুভমেন্ট, মানে আমাদের আন্দোলন পরিচালনার জন্য। বাজার থেকে প্রায় ৫০/৬০ হাজার টাকা তোলা হয়েছিলো এবং সেই টাকাগুলো ছিলো রাধাবল্লভ সাহা নামে এক ব্যবসায়ীর কাছে। রাধাবল্লভ বাবু আগের দিন অর্থাৎ ১৫ তারিখে আমাদের সাথে পত্মীতলা গিয়ে বায়তুল্লাহ সাহেবের সাথে ইন্ডিয়া চলে যান। তো মোরশেদ কতগুলো হোলিগানকে অর্থাৎ গুন্ডাপান্ডাকে সঙ্গে নিয়ে এসে বলছে যে, রাধাবল্লভ বাবুকে আমরা চাই। সে গেলো কোথায়? মোরশেদ পরবর্তীতে এরশাদের সময়ে জাতীয় পার্টির টিকেটে এম. পি. হয়েছিলো। তার সাথে তখন কতগুলো খারাপ এলিমেন্টস থাকতো। ওদের নিয়েই সে এসেছিলো।



লোকজন আমাকে ডাকলো। তারপর বললো যে, মোরশেদ এই রকম হৈ হুল্লোড় করছে। তো আমি উঠে গিয়ে তাকে বললাম যে, কি আপনাদের কথা? সে বললো যে, আমরা রাধাবল্লভ বাবুকে চাই। আমি বললাম কেন রাধাবল্লভ বাবুকে দরকার? সে বললো, উনি টাকা নিয়ে গেছেন। আমি বললাম যে, টাকা তোমাদের কারো তো নয়। সংগ্রাম পরিষদের টাকা। টাকা রাধাবল্লভ বাবুর কাছে আছে সেটা আমরা বুঝবো। সংগ্রাম পরিষদ যারা চালায় তারা সেটা বুঝবে। তোমাদের এখানে কি? তারা বলে না আমরা টাকা চাই। দিতে হবে। নইলে আমরা ইয়ে করবো।



তখন আমি বুঝলাম যে, এরা স্যাবোটাজ বা অন্য কোনো লাইনে গেছে। এদের অবশ্যই প্রতিরোধ করতে হবে। আমি সঙ্গে সঙ্গে আমাদের স্বেচ্ছাসেবকদের বললাম যে, তোমরা রাইফেল রেডি করো। ফাঁকা গুলি করে এদের সরিয়ে দিতে হবে। মনে হচ্ছে সেটা না করলে এরা যাবে না। তোমরা রাইফেল রেডি করো। আমি ওদের ১, ২, ৩ বলবো, এর মধ্যে চলে না গেলে তোমরা ফায়ার করবে। তারপর মোরশেদকে বললাম যে, তোমরা এখানে কেন এসেছো? আমি এখন ১, ২, ৩ বলবো, এর মধ্যে যদি তোমরা চলে না যাও তাহলে আমি ফায়ার করার অর্ডার দিবো। তোমাদের কারো কাছে টাকার হিসাব দিতে হবে না। ওটা আমরাই করতে পারি। সংগ্রাম পরিষদ আছে। টাকা সংগ্রাম পরিষদের নামে তোলা হয়েছে। সেটা সংগ্রাম পরিষদ বুঝবে। যখন হিসাব দেওয়ার সময় আসবে তখন তারা পাবলিককে হিসাব দেবে। হু আর ইউ? তোমরা কে? হোয়াট ইজ কনট্রিবিউশন হেয়ার। তোমরা এখানে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছো। যাহোক, আমি ১, ২ বলার পর দেখি তারা আর কেউ নাই। সব ভেগে গেছে।



ঐ ঘটনার পরেই আমরা মনে করলাম যে, আমাদের আরেকটু সতর্ক হওয়া দরকার এবং নিজেদের মধ্যে আলোচনা করা দরকার। তখন আমি ওখান থেকে বেরিয়ে ই.পি.আর ক্যাম্পে গেলাম। ওখানে গিয়ে দেখলাম যে, মেজর নজমুল হক তার চুলটুল কেটে ফেলেছে। একদম ন্যাড়া মাথা! সেও পত্মীতলা থেকে ভোরে আমার সাথে নওগাঁ এসেছে। তার মাথায় সাদা টুপি। আমাকে দেখে সে বললো যে, ভাই কি ব্যাপার? দেখলাম যে, উনি খুব হতাশ হয়ে গেছেন।



একটু পর মেজর নজমুল আমাকে বললেন যে, দেখেন জলিল সাহেব একটা নিশ্চিত অবস্থা ছেড়ে আমরা অনিশ্চিতের পথে যাত্রা করছি। আমি বললাম যে, দেখেন এখন তো এ সব আর চিন্তা করে কোনো লাভ নাই। এখন কিন্তু দোদুল্যমানতায় ভুগলে আগাতে পারবেন না। আপনি দোদুল্যমানতায় ভুগবেন না। আমরা যে লক্ষ্যে চলছি, লক্ষ্য আদায়ের জন্য যা করা দরকার তা করতে হবে। আপনি হতাশ হলে তো মুশকিল। আপনার এখানে ই.পি.আর, টি.পি.আর. যারা আছে তারা তো আপনার লিডারশিপেই দাঁড়াবে। আমরা যারা পলিটিক্যাল লিডারশিপ দেই তাদের চেয়ে আপনাদের মতো লিডারশিপই যুদ্ধ ক্ষেত্রে মেইন। ওয়ার কমান্ডিং ইজ ইউরস। দেখলাম উনি খুবই নার্ভাস হয়ে গেছেন। আমাকে কয়েকবার বললেন, আমি একটা অনিশ্চিত অবস্থায় পড়ে গেলাম। আগামীতে কি হবে কে জানে! আমরা একটা অনিশ্চিত অবস্থায় যাচ্ছি!



যাহোক, ওনার সাথে কথা বলতে বলতে ওখানে একটা কল আসলো ময়মনসিংহ থেকে। একজন বাঙালি সামরিক অফিসার ফোন করেছেন ওখানে। প্রথমে মেজর নজমুল সাহেব তার সাথে কথা বললেন। তারপরে তিনি আমাকে দিলেন। আমি তাকে বললাম যে, কি ব্যাপার? উনি বললেন যে, আপনারা ফাইট চালিয়ে যান। আমরা ময়মনসিংহে রিট্রিট করছি। এখন মধুপুর জঙ্গলের দিকে আছি। আপনারা অরগানাইজডওয়েতে ফাইটটা চালিয়ে যান। টোটাল ফাইট ছাড়া আমাদের মুক্তির পথ নাই। ওনার সাথে কথা বলবার পর আমি মেজর নজমুলকে বললাম যে, শুনলেন তো কি অবস্থা। সুতরাং এটা নিয়ে আপনি আর দুশ্চিন্তা করেন না। ওনাকে বুঝটুঝ দিয়ে আমি চলে আসলাম আমাদের ক্যাম্পে।



দুপুরের দিকে খবর পেলাম যে, মেজর নজমুল ইপিআর ক্যাম্পে নাই! ইপিআর সৈনিকদের ২/৩ জন দৌড়ে এসে আমাকে বললো যে, মেজর সাহেব আমাদের ডেকে বলে দিয়েছেন যে, যার যার পথে তোমরা চলে যেতে পারো। আই অ্যাম অলসো লীভিং। আমি তো সেটা শুনে খুব অবাক হলাম। মেজর নজমুল আমাকে কিছু না বলেই শুধু ওদেরকে নির্দেশ দিয়ে চলে গেছেন। আমি দেখলাম যে, আমরা তো এভাবে ছেড়ে দিয়ে যেতে পারি না। যা হয় হবে। প্রতিরোধ যতোটা সম্ভব আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে। এর মধ্যে আর একটি ঘটনা ঘটেছে। পাঞ্জাবি অফিসার যাদের বন্দি করে রাখা হয়েছিলো তারা ইপিআরদের হাতে মারা পড়েছে। এ ঘটনা ঘটেছে আমার অগোচরে।



প্র : কিভাবে এ ঘটনা ঘটলো?



উ : তখন আমি নওগাঁর বাইরে ছিলাম। ইন্ডিয়াতে গিয়েছিলাম। তখন নওগাঁর এস.ডি.ও.-র চার্জে ছিলেন এম. এ. আজিজ। উনি বাঙালি। আমরাই তাঁকে ঐ দায়িত্বে বসিয়েছিলাম। আমি ইন্ডিয়া থেকে ফিরে এসে শুনলাম যে, ওনার কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে ইপিআররা পাঞ্জাবি অফিসারদের বের করে সান্তাহারের কাছাকাছি এক জায়গায় নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলে পুঁতে রেখেছে। এটা আমার নলেজের বাইরে ছিলো। আমি খবরটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আজিজ সাহেবকে গিয়ে বললাম, আপনি পারমিশন দিলেন জেলখানা থেকে তাদেরকে বের করার জন্য? তো উনি বললেন যে, ঐ সময় আমার কিছু করার ছিলো না। আমি বললাম যে, আপনি তো আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারতেন। এদেরকে মেরে ফেলবো, এ রকম তো কোনো কথা ছিলো না। এরা তিনজন সিনিয়র অফিসার। তাছাড়া একজন তো আপনারও এস.ডি.ও. ছিলেন। ঐ লোক তো আমাদের এন্টি কিছু করে নাই। বুঝলাম তিনজন আর্মি অফিসার ছিলো ওদের মেরে ফেলে দিয়েছেন। কিন্তু এস.ডি.ও.-কে তো মেরে ফেলা ঠিক হয় নাই। তখন আজিজ সাহেব বললেন যে, ওরা আমাকে চাপ দিয়েছে, আমি পারমিশন দিয়ে দিয়েছি। তারা জেলখানা থেকে নিয়ে গিয়ে ওদের মেরে ফেলেছে। এ রকম যখন অবস্থা তখন হঠাৎ একটা খবর আসলো যে, রাজশাহী আমাদের দখলে। ১৬ তারিখ বেলা ন’টা সাড়ে ন’টার দিকে এই খবর আসলো।



প্র : এপ্রিলের ১৬ তারিখে?



উ : হ্যাঁ, ১৬ তারিখে। এক ঘন্টা পরে আবার খবর আসলো যে, রাজশাহী আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। আমাদের লোকজন ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। এ রকম নানা ধরনের খবর সব আসা শুরু হলো। আমরা রাজশাহী জয় করেছি শুনে আমি গোটা নওগাঁ শহরে মাইকিং করালাম। আবার এক ঘন্টা পরে যখন খবর আসল রাজশাহী হাতছাড়া হয়ে গেছে তখন ভাবলাম, এটা মাইকিং করালে মানুষের মধ্যে প্যানিকের সৃষ্টি হয়ে যাবে। তখন রাজশাহীর কথা কিছু না বলে সব জায়গায় মাইকিংয়ের মাধ্যমে আমরা জনগণকে বললাম যে, আপনারা যে যার নিরাপদ জায়গায় যান। ঐ দিন আমি আমার ক্যাম্পে বসে। ইতোমধ্যে ম্যাসাকার তো হয়ে গেছে সান্তাহারে। প্রচুর বিহারীকে মেরে ফেলা হয়েছে। পুরো এলাকা পাবলিক ঘেরাও করে তাদের মেরে ফেলেছে। বহু বিহারী নওগাঁতে পালায়ে আসছে। আমরা তাদের কাউকে কাউকে শেল্টার দিয়েছি। অনেকে আবার শেল্টার দিতে ভয় পেয়েছে। খুব হ্যাপাজার্ড এক অবস্থা।



প্র : নওগাঁতেও তো বিহারী মারা গেছে?



উ : হ্যাঁ, নওগাঁতেও মারা গেছে। বিহারী বেশি মারা গেছে আসলে সান্তাহারে। ৪/৫ হাজার বিহারী মারা গেছে ওখানে। দুপুর বেলা একটা দেড়টার দিকে আমি আমার ক্যাম্পেই বসা। অনেকে আমাকে বললো যে, দেখো, তোমার আর এখানে থাকা ঠিক না। এখন আর কারো হাতে কোনো কন্ট্রোল নাই। সব কন্ট্রোলের বাইরে চলে গেছে। তুমি বাসায় যাও। তোমার যে কমান্ড আছে সেই কমান্ডটা তুমি বাসা থেকে দাও। আমরা তোমার বাসায় বসে সব কো-অর্ডিনেট করবো। তোমার সিকিউরিটি আমরা দেবো। তুমি বাসায় চলো। বাসা থেকেই যা করার করো।



যাহোক, আমি সবার পরামর্শ শুনে বাসায় চলে গেলাম। এর মধ্যে আবার কিছু কিলার আমার কাছে আসে। এরা পাঞ্জাবি-বেলুচ ইপিআর জওয়ান-যাদের বন্দি করে রাখা হয়েছিলো-এদেরকে কিল করবে। অরগানাইজ হয়েই ওরা এসেছে। প্রায় ২৫/৩০ জন। কিলাররা আমাকে বললো যে, ওদেরকে নিয়ে যাবার অনুমতিটা আমার দিতে হবে। আমি বললাম যে, এই অনুমতি আমি দিতে পারবো না। এতগুলো মানুষ মেরে ফেলার অনুমতি দেবো এটা কোনো কথা হলো না কি! তারা বলে, না আপনাকে দিতে হবে। এর মধ্যে আমাদের নিজেদের মধ্যেই এটা নিয়ে দ্বন্দ্ব হতেই আমাদের এক লোক ছুরিকাহত হয়ে গেলো। তার চিকিৎসার জন্য কোনো ডাক্তার পাওয়া যাচ্ছে না। তখন আমি খবর পেলাম হাসপাতালে এক ডাক্তার আছেন। সেখানে আমি আহত লোকটাকে নিয়ে গেলাম। এদিকে যারা অবাঙালি ইপিআরদের মারতে চায় তারা আমার পিছে পিছে হাসপাতালে গেলো। গিয়ে বলে আপনি পারমিশন দেন আমাদের। তাদের সবার হাতে বড় বড় ছোরা। সবাই মদ খেয়ে আসছে। আসলে মেরে ফেলার সব প্রস্তুতি নিয়েই তারা আসছে।



প্র : এই কিলাররা কি বাঙালি?



উ : হ্যাঁ, সব বাঙালি। ওখানে তাদের রেজিস্ট করার মতো আমার কোনো শক্তি তখন ছিলো না। এমন হতে পারে যে, আমাকেই তারা অ্যাটাক করতে পারে। আমি বললাম যে, তোমরা অপেক্ষা করো, আমি দেখি। আসলে সেটা বলে আমি সময় ক্ষেপনের চেষ্টা করছিলাম। ওরা বললো, না আপনি এখনই পারমিশন দেন। বাকিটা আমরা করবো। আমি গাড়িতে উঠতেই ওরা আবার বললো যে, আপনি পারমিশন দিয়ে যান। তো আমি বললাম যে, ঠিক আছে, যাও। উপায় তো নাই। তারপর আমি ব্রিজের মোড়ে একটা দোকানে গিয়ে বসলাম। আমি ওখানে থাকতেই দেখলাম যে, এক ট্রাক পাঞ্জাবি ইপিআরকে নিয়ে ওরা চলে গেলো। আগেই ওরা একটা গর্ত করে রেখেছিলো। সেখানে তারা ঐ ১২১ জনকে মেরে ঐ গর্তের মধ্যে পুঁতে রাখলো। আমি তো ওখানেই। তারপর আমি বাসায় গেলাম। বাসায় গিয়ে আমি চিন্তা করছি কি করা যায়!



প্র : এটা এপ্রিলের কতো তারিখে?



উ : এপ্রিলের ১৬ তারিখে। এগুলো সব ১৬ তারিখেই ঘটছে। ১৬ তারিখ রাতে আমি মনে মনে চিন্তা করছিলাম যে, সবাই আমাকে বললো যে, আমার এখানে থাকা আর ঠিক হবে না, ইউ মাস্ট লীভ দ্যা টাউন। এ সব চিন্তা থেকে আমি ৩/৪টা গাড়িতে আমাদের বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে মানে সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দকে নিয়ে ঐ রাতেই বাংলাদেশ-ইন্ডিয়ার বর্ডারে গেলাম।



প্র : ১৬ তারিখের আগে আপনাদের সাথে কি ইন্ডিয়ার কারো কোনো যোগাযোগ হয়েছিলো?



উ : না, না। বায়তুল্লাহ সাহেবদেরকে পাঠালাম ১৫ তারিখ সকালে। ওনাকে পাঠিয়ে দেওয়ার পরে তো ঘটনাগুলো হচ্ছে। ওনাকে পাঠিয়ে দিয়ে আমরা শহরে ফিরে আসার আগেই তো এই সমস্ত ঘটনাগুলো ঘটতে শুরু করে।



প্র : এর মধ্যে ইন্ডিয়ার সাথে আপনাদের কোনো যোগাযোগ হয়নি?



উ : না। ইন্ডিয়ার সাথে কোনো যোগাযোগ আমাদের হয়নি। ১৬ তারিখ রাতে আমি চলে গেলাম ইন্ডিয়ান বর্ডারে।



প্র : কোন্‌ বর্ডার?



উ : বালুরঘাট বর্ডার। তার আগে পত্মীতলায় গেলাম। মানে আমার ফ্যামিলি যেখানে রেখে আসছিলাম। আমি যখন রাতে ওখানে গেলাম তখন গিয়ে দেখলাম যে, আমার ফ্যামিলি ওখানে নাই। মেজর নজমুলের ফ্যামিলিও নাই। কারো ফ্যামিলিই নাই। ঐ বাড়িতেই কেউ নাই। তখন আমি চিন্তা করলাম যে, কোথায় গেল এরা! তারপর সকাল বেলা মজিদ ব্যাক করলো এবং বললো যে, কোনো সমস্যা হয় নাই। আমার শ্বশুর বাড়িতে ওদের সবাইকে রেখে আসছি। ওটা পত্মীতলা থেকে আরো ২০ মাইল দূরে। জায়গাটা অন্য থানার মধ্যে। নকচা বলে একটা গ্রামে তার শ্বশুর বাড়ি, সেখানে নিয়ে রেখেছে। আমি বললাম ঠিক আছে। তারপরে আমি গেলাম বালুরঘাটে।

এপ্রিলের ১৭ তারিখেই আমি প্রথম গেলাম বালুরঘাটে। সকালবেলা বালুরঘাটে যাবার পর ওখান থেকে হিলিতে গেলাম। ভাবলাম ওখানে গিয়ে দেখি কিছু রি-ইনফোর্সমেন্ট পাওয়া যায় কি না। হিলিতে গিয়ে দেখলাম ক্যাপ্টেন আনোয়ারের নেতৃত্বে ওখানে একদল বাঙালি সামরিক যোদ্ধা রয়েছে। কিন্তু ওরা বললো যে, আমাদের দেওয়ার মতো কিছু নাই। আমরা দিনাজপুরের দিক থেকে ফাইট করতে করতে এখানে এসেছি। এখানে আমাদের কিছু নাই। আমাদের যোদ্ধারা সব বর্ডারে ফাইট করছে। তখন আমি ওখান থেকে ফিরে আসলাম।



ফিরে এসে আমি বর্ডারে গেলাম দেখতে যে, নওগাঁর ইপিআর-রা কোথায় গেলো। কারণ তখন বর্ডারে আমার ক্যাম্প করা দরকার। খুঁজতে খুঁজতে আমি দেখলাম যে, পত্মীতলা থেকে ধামুইরহাটের মধ্যে বর্ডারের পাশে অনেকগুলো জায়গায় ইপিআর-রা বিভিন্ন বাড়িতে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। আর নওগাঁর এসডিপিও মানে মহকুমা পুলিশ কর্মকর্তা মুজাফফর রহমান চৌধুরী নামে একজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি এক সময় মুসলিম লীগের এম এন এ ছিলেন। ইস্ট পাকিস্তান মুসলিম লীগের ভাইস প্রেসিডেন্টও ছিলেন। ওনার বাড়িতে এস.ডি.পি.ও কিছু পুলিশ সঙ্গে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। আমি ওখানে যেয়ে তাকে বললাম যে, আপনি শেষ পর্যন্ত এখানে আশ্রয় নিলেন! অবশ্য চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুব ভালো ছিলো। তো উনি বললেন যে, দেখো বাবা, আমি মুসলিম লীগ করি, তারপরও তোমাদের সঙ্গে আছি।



মুজাফফর রহমান চৌধুরীর ফারসিপাড়ার জমিদার বাড়িতে এস. ডি. পিও. আশ্রয় নিয়েছিলেন। ফারসিপাড়ার জমিদার ছিলেন মুজাফফর রহমান চৌধুরী। আমি এসডিপিও-কে দেখে বললাম, আপনি এখানে কেন? আমি তখন ইপিআর জওয়ান যারা এদিক সেদিক পালায়ে ছিলো তাদের সবাইকে একত্র করার চেষ্টা করছি। ওখানে চকচন্ডী, চকচাঁপাই বলে যে দু’টা জায়গা আছে তাদেরকে সেখানে অ্যাসেম্বল করবো স্থির করেছি। ঠিক বর্ডারের উপরই জায়গাটা। এস.ডি.পি.ও. আমাকে বলে যে, আমাদের জীবনের তো কোনো মূল্য নাই। এ নাই! সে নাই!

আমি তখন তাকে বললাম যে, আপনাদের জীবনের চাইতে আমাদের জীবনের মূল্য কম না কি? আপনি তো ২/৩ বছর পর অবসর নেবেন। আমি বিদেশে লেখাপড়া করতাম। সেই মানুষ আমি আজকে মুক্তিযুদ্ধ করছি। আর আপনি তো সরকারি টাকায় মানুষ হয়েছেন। আজকে আপনি আপনার নিজের দায়িত্ব বাদ দিয়ে মুজাফফর চৌধুরীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। আপনি বিট্রে করলেন কেন আমাদের সঙ্গে? আপনি আসার আগে তো আমাদের বলে আসতে পারতেন। গোটা পুলিশ ফোর্সকে ছেড়ে দিয়েছেন আপনি। ঐ সময়ই মুজাফফর সাহেব আমাকে বললেন যে, বাবা দেখো, আমি মুসলিম লীগ করি আর যাই করি, তোমাদের এই আন্দোলনের প্রতি আমার সমর্থন আছে। কোনো সময় যদি আমাকে দরকার হয় আমাকে বলো, আমি করবো।



আমি এসডিপিও-কে বললাম যে, আপনি আমার সাথে গাড়িতে ওঠেন। চকচন্ডীতে যে ক্যাম্প করবো সেই ক্যাম্পের দায়িত্বে আপনি থাকবেন। উনি খুব হেজিটেড করছিলেন, তখন আমি বললাম যে, দেখেন আপনি হেজিটেড করলে আমি এখানে আপনাকে গুলি করে মেরে রেখে যাবো। আমি আপনাকে এখানে জীবন্ত রেখে যাবো না। হয় আপনি আমার সাথে গাড়িতে উঠবেন নয়তো জীবন দেবেন। কোন্‌টা পছন্দ আপনার? কারণ এখন আর কমপ্রোমাইজের কোনো সুযোগ নাই। আর মুজাফফর সাহেবকে বললাম যে, চাচা আপনি মুসলিম লীগ করেন অথচ আপনি পর্যন্ত আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিয়েছেন। যদি কোনো সময় সাহায্যের দরকার হয় আপনার কাছে চাইবো। সাহায্য করবেন আশা করি। উনি বললেন, বাবারে তোমার যখনই যে সাহায্য লাগবে তুমি আমাকে বলবে। আর আমি তোমার সাথে বালুরঘাট যেতে চাইলে আমাকে গ্যারান্টি দিতে হবে। কারণ আমার জমিদারিটা ঐ এলাকাতেও ছিলো। জমিদারির কারণে ঐ এলাকার মাইনরিটি কমিউনিটির সাথে আমাদের কিছু পারিবারিক দ্বন্দ্ব আছে। আমি ওখানে গেলে আমার জীবনের নিরাপত্তা নাই। সেই নিরাপত্তা দিতে পারলে আমি তোমাদের সাথে যাবো।



যাহোক, শেষ পর্যন্ত এসডিপিও আমার সঙ্গে আসলেন। ইপিআর, পুলিশ-টুলিশ নিয়ে চকচন্ডী নামক স্থানে একটা ক্যাম্প করা হলো। তাকে সেই ক্যাম্পের চার্জ দিয়ে বললাম আপনি এখানে থাকেন। আমি নওগাঁ শহর থেকে ঘুরে আসি।



প্র : জায়গাটা কি বাংলাদেশের ভিতরে?



উ : হ্যাঁ, বাংলাদেশের ভিতরে। ওটা ইপিআর-এর একটা বিওপি ছিলো।



প্র : চকচন্ডী বি.ও.পি.-তে আপনি প্রথম ক্যাম্প করলেন?



উ : হ্যাঁ। চকচন্ডী বিওপিতে আমি তাদের অ্যাসেম্বল করলাম। করে আমি আবার নওগাঁতে ব্যাক করলাম।



প্র : তখন নওগাঁ ফল করেনি?



উ : না, তখনও ফল করেনি। এটা বোধহয় ১৯ তারিখ হবে। ১৯ তারিখে আমি আবার ব্যাক করেছি। ব্যাক করে আমি নওগাঁতে আমার যারা ঘনিষ্ঠজন ছিলো তাদেরকে খবর দিলাম যে, আমি ব্যাক করেছি। তোমরা যারা শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবছো তারা থাকো। আর আনসার টানসারদের এক সঙ্গে করো। নওগাঁতে ব্যাক করার পর জানলাম যে, সেখানে শান্তি কমিটি হয়ে গেছে। আমি মাত্র ২/৩ দিন ছিলাম না, এর মধ্যেই শান্তি কমিটি হয়ে গেছে। যদিও নওগাঁ তখনো ফল করেনি। পাক বাহিনীও সেখানে আসেনি। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছে বেচন বিহারী বলে এক বিহারী। সেক্রেটারি হয়েছে শামুসদ্দীন। উনি পরে বি.এন.পি. দলীয় এম.পি. হয়েছিলেন। তারপরে বদিউল আলম, উনি শান্তি কমিটির ভাইস-চেয়ারম্যান। শামসুল আলম, ভাইস চেয়ারম্যান, তারপর বাংলাদেশ ন্যাশনাল ফুটবল টীমের ক্যাপ্টেন পিন্টুও শান্তি কমিটিতে গেছে। পিন্টু আমার সহপাঠী। আমি পিন্টুকে খবর দিলাম আর বললাম যে, সে কেন তাদের সঙ্গে থাকবে। সে আমাদের সঙ্গেই থাকবে। তাকে আমাদের সঙ্গে থাকতে হবে।



যাহোক, আমি ইন্ডিয়া থেকে নওগাঁ আসার সময় মোজাম্মেল হক বলে একজনকে খবর দিয়েছিলাম। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ওনাকে আমি খবর দিলাম যে, ভাই আমি নওগাঁ যাচ্ছি। তাঁকে আরো খবর দিলাম যে, হাপানীয়া বলে একটা জায়গা আছে, সেখানে যেন তিনি আমাকে রিসিভ করেন বা তার ব্যবস্থা করেন। আমার পুরোপুরি গোছগাছ এখনও হয় নাই। আমি সব কিছু গুছিয়ে আবার রিট্রিট করবো।



তাকে খবর দিয়েই আমি রওনা হয়েছিলাম। নওগাঁ শহরে প্রবেশ করার পর জেলা স্কুলের সামনে শামসুদ্দীন সাহেবকে দেখলাম। তিনি পিস কমিটির সেক্রেটারি হয়েছেন। দেখি উনি গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন। পাশে তার বাবা বসে। তার বাবা মুনির হাজী সাহেব। আমি ঐ গাড়ি থামিয়ে বললাম, দাঁড়ান। আমি ৪/৫টা গাড়ি নিয়ে নওগাঁ এসেছি। আমার সাথে ই.পি.আর. আছে, পুলিশও আছে। আমাদের ছেলেরাও আছে উইথ আর্মস। তারপরে আমি ওনাদের বললাম যে, আপনারা নামেন গাড়ি থেকে। ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট। আপনি শান্তি কমিটির সেক্রেটারি হয়েছেন! সুতরাং আপনি আমাদের গাড়িতে ওঠেন। ঐ সময় তার বাবা আমাকে বললেন, জলিল আমার ছেলেকে মেরো না। আমি তাকে বললাম, চাচা সে ব্যাপারে আপনার চিন্তা করতে হবে না। আপনাকে আমি বাসায় পৌঁছে দিচ্ছি। আমি আমার গাড়ির ড্রাইভারকে বললাম, তুই নিয়ে যা ওনাকে। ড্রাইভার তাকে নিয়ে গেলো। আর শামসুদ্দীন সাহেবকে আমরা অ্যারেস্ট করলাম। তারপরে একটু আগায়ে গিয়ে অ্যাডভোকেট বদিউল আলমকে অ্যারেস্ট করলাম। বদিউল আলম আর্মির এক্স ক্যাপ্টেন। উনি পিস কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান হয়েছেন। তাকে অ্যারেস্ট করে ইপিআর ক্যাম্পের যারা রিট্রিট করেছিলো তাদের খবর দিয়ে আবার ওখানে সমবেত করার ব্যবস্থা করলাম।



কিছুক্ষণ পর ইপিআর ক্যাম্পে গেলাম। ওদেরকে আমি বললাম যে, আপনারা এক কাজ করেন, রাজশাহী থেকে আসার পথে মান্দা নদীর এপারে আপনাদের পজিশন নিতে হবে। আর বলিহারে যে ব্রিজ আছে সেটা ভাঙতে হবে। এই দায়িত্বটা আপনারা নিয়ে যান। ইপিআরের আর একটা সেকশনকে বললাম, তোমরা আত্রাই চলে যাও। আত্রাইয়ের শাহগোলা ব্রিজটা তোমরা ভেঙে দেবা যাতে রেলওয়ে যোগাযোগটা নষ্ট হয়ে যায়। আর আরেকটা সেকশনকে বললাম, তোমরা বগুড়া জেলার আদমদীঘির এই দিকটা ব্লক করবা। তাহলে নওগাঁটা অন্তত: আরো কয়েক দিন ফ্রি রাখা যাবে। এর মধ্যে আমরা সব কিছু গুছিয়ে নওগাঁ থেকে চলে যেতে পারবো। তারপর ইপিআরদের খাওয়ায়ে-দাওয়ায়ে আমরা ট্রাকে তুলে দিলাম। আমরা তাদের ঐ তিন জায়গায় পাঠায়ে দেবো তখন। ঐ সময় ই.পি.-আর.রা বললো যে, আমরা ৩/৪ মাস বেতন পাই নাই, বেতন না পেলে আমরা যাবো না।



তাদের এ কথা শুনে আমার খুব রাগ হলো। আমার তখন মনে হলো যে, এদের সবগুলোকে মেরে পাশের নদীতে ফেলে দেই। আবার মনে করলাম যে, এতগুলা মানুষ আমি মারবো! রাগ কমে গেলে আমি ওদের বললাম যে, ঠিক আছে, হিসাব করো কার কতো বেতন। টাকা ছিলো আমার কাছে। আমি হিসাব করে সবাইকে বেতন দিলাম এবং বললাম যে, আপনারা সবাই বেতন পেলেন, নাউ ইউ মাস্ট অবেই দ্যা কমাণ্ড। আপনাদের যেতে হবে এখন। যাহোক, ওদেরকে তিন জায়গায় পাঠায়ে দিয়ে সেদিন রাতে চিন্তা করলাম যে, যুদ্ধের জন্য তো টাকার দরকার হবে। টাকা পাবো কোথায়? তখন ঠিক হলো যে, ব্যাংকে টাকা জমা আছে, সেটা আমাদের নিতে হবে এবং টাকাটা ভারতে নিয়ে যেতে হবে। ঐ ব্যাংকের ম্যানেজার তখন ছিলো ওয়াজেদ আলী খান।



প্র : ওয়াজেদ আলী খান কোন্‌ ব্যাংকের ম্যানেজার ছিলেন?



উ : তৎকালীন ন্যাশনাল ব্যাংক। ঐ ব্যাংক এখন সোনালী ব্যাংক নামে পরিচিত। ন্যাশনাল ব্যাংকের ম্যানেজার ছিলেন ওয়াজেদ আলী সাহেব। তিনি বিহারী ছিলেন। আমরা সব বিহারীর খপ্পরে পড়ে গেছি। আমরা তার কাছে গেলাম। তাকে আমরা বললাম যে, আপনি ব্যাংকে চলুন। আমরা ওখান থেকে টাকা নেবো। কিন্তু সে ব্যাংকে গিয়ে ভল্ট খুলে দেবে না। বলে, না এটা আমার পক্ষে সম্ভব না। পরে আমাদের চাপে বললো যে, সেটা করতে হলে ক্যাশিয়ারকে দরকার। তখন আমরা ক্যাশিয়ারকেও ওখানে আনালাম। ক্যাশিয়ার বলে যে, না এটা খোলা যাবে না। এটা ওটা নানা কথা সে বললো। ক্যাশিয়ার অবশ্য বাঙালি। তার নোয়াখালি বাড়ি।



এদিকে রাত তখন প্রায় বারোটা সাড়ে বারোটা হয়ে গেছে। তারা কোনো কিছুতেই রাজি হয় না। এ অবস্থায় আমি আমার ছেলেপেলেদের বললাম যে, বুঝেছি এরা ব্যাংকের ভল্ট খুলে দেবে না। তোরা এদের দাঁড় করা। চাবি তো পেয়েছি। আমরা দু’জন ঐ দু’জনের বুকে পিস্তল ধরেছি। একজন ম্যানেজারের বুকে ধরেছি। আর একজন ক্যাশিয়ারের বুকে ধরেছে। আমি বললাম যে, এখন আমি ট্রিগার টিপবো। এখন আপনারা বলেন, যাবেন কি যাবেন না? আমি চাবি পেয়েছি। এখন আপনাদের মেরে ফেলে দিয়ে ভল্ট খুলে টাকা নিয়ে যাবো। আমি যে টাকা নেবো সেটা আমি লিখে দিয়ে যাবো যে, আমি স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য টাকা নিচ্ছি। আমি রসিদ দিয়ে টাকা নেবো। তা আপনাদের অসুবিধাটা কি? তখন ওরা দু’জন বললো, চলেন। তারা দু’জন রাজি হবার পর আমরা ব্যাংকে গেলাম।



আমাদের তো অত আইডিয়া নাই ব্যাংকের ভল্ট সম্পর্কে, বা ভল্টে কি পরিমাণ টাকা আছে সেটাও আমাদের জানা ছিলো না। ওরা ভল্টের দরজা অর্ধেক খুলেছে, অর্ধেক খোলে নাই। ঐ অবস্থায়ই দেখলাম তাতে অনেক টাকা। এখন সে টাকা কিসে নেবো? বাজার থেকে চাল মরিচের বস্তা নিয়ে আসালাম ছেলেপেলেদের পাঠিয়ে। তারপর বস্তার মধ্যে টাকা তুললাম। শুধু বাণ্ডিল গুনে তোলা হলো। বান্ডিল অনুযায়ী তারা বললো মোট ৭১ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা। সব টাকাতো তখন কাউন্ট করার সময় নাই! টাকা নিয়ে আমি তাদের রসিদ দিলাম। সে রশিদে আমি সই করলাম, ন্যাপের পোনা সাহেব সই করলো, আতাউর রহমান এম. পি. এবং এম. আর. চৌধুরী-এই চারজন সই করলাম। সই করলাম এবং লিখলাম যে, আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য এই টাকা নিলাম। তারপর ঐ টাকা নিয়ে আমরা চলে গেলাম বালুরঘাটে। টাকা ইপিআরের দু’টি ট্রাকে করে আমরা নিয়েছিলাম। যাওয়ার সময় সাথে আমরা গ্রেফতারকৃতদেরও নিয়েছিলাম। পথে আমার সঙ্গের ছেলেরা তাদের মেরে ফেলে দিতে চাইলে আমি নিষেধ করলাম। বললাম যে, না এটা করা ঠিক হবে না। এদিকে ইন্ডিয়ায় যাওয়ার সময় পথিমধ্যে অ্যাডভোকেট বদিউল আলম কিভাবে যেন পালিয়ে গেলো। অন্যদের আমরা বালুরঘাট থানায় সোপর্দ করলাম।



প্র : আপনার সাথে তখন কি পরিমাণ সশস্ত্র যোদ্ধা ছিলো?



উ : আমার সাথে টোটাল ছিলো প্রায় ১০০ মতো। ইপিআর, পুলিশ আর ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছেলেরা। সবাই আছে। আমি ২০ এপ্রিল তারিখে ভোরবেলা গিয়ে পৌঁছালাম বালুরঘাটে। বালুরঘাটে পৌঁছে ভাবলাম কোথায় নিয়ে যাবো এতো টাকা! পরে টাকাগুলো বিএসএফ ক্যাম্পের স্থানীয় কমাণ্ডারের কাছে নিয়ে গেলাম। তার ক্যাম্প কোয়ার্টারে গিয়ে বললাম, এই রকম টাকা নিয়ে এস্‌ছি। টাকাগুলো স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইণ্ডিয়াতে আমরা রাখতে চাই। তার আগে টাকাগুলো আপনার এখানে আমরা গুণে দেখবো। তারপর আমরা ব্যাংকে নিয়ে যেতে চাই। তো উনি বললেন ঠিক আছে। টাকা যখন কাউন্ট করা হচ্ছে তখন ঐ বিএসএফ কমান্ডার আমাকে ওখান থেকে ডেকে নিয়ে বলে যে, আমাকে কিছু টাকা দেন। আমি তাকে বলি আপনাকে কেন টাকা দেবো! তখন সে বলে আমাকে টাকা না দিলে হোয়াই শ্যুড আই হেল্প ইউ?



প্র : বিএসএফ কমাণ্ডার ঐ টাকার শেয়ার চাইলো?



উ : হ্যাঁ, বিএসএফ কমাণ্ডার ঐ টাকার শেয়ার চাইলো। যাহোক, আমি ভাবলাম এখন যদি তাকে না বলি তাতে সে হাঙ্গামা করতে পারে। সে জন্য আমি তাকে বললাম আগে টাকাগুলো কাউন্ট হোক। কাউন্ট শেষ হলে আপনি টাকাগুলো আপাতত: আপনার এখানে রাখতে দিন। টাকা আপনাকে পরে দেবো। আমি এখন একটু ঘুরে আসি। এই বলে টাকাগুলো ওখানেই রাখলাম আমাদের গার্ড দিয়ে। আর কয়েকজন গুণতে থাকলো।



প্র : তারপর আপনি কি করলেন?



উ : আমি তখনই চলে গেলাম রায়গঞ্জে। শুনলাম সেখানে বিএসএফ-এর আঞ্চলিক হেড কোয়ার্টার। রায়গঞ্জে গিয়ে আরো জানতে পারলাম বিএসএফ-এর যিনি ওখানকার কমান্ডার তার নাম কর্নেল মুখার্জি। তিনি বাঙালি। আমি তার সঙ্গে দেখা করে ঘটনাটা তাকে বললাম। তাকে বললাম যে, আমি বাংলাদেশ থেকে টাকা নিয়ে এসেছি যুদ্ধের প্রয়োজনে। ঐ টাকা রেখেছি বালুরঘাট বিএসএফ ক্যাম্পে। সে টাকা ওখানে কাউন্ট করা হচ্ছে। এখন ঐ বিএসএফ কমান্ডার তো টাকার ভাগ চাচ্ছে আমার কাছে। হি ডিমান্ডিং সাম মানি ফ্রম দিজ। কিন্তু আমরা কেন তাকে টাকা দেবো? আমরা তো ঐ টাকা এনেছি মুক্তিযুদ্ধ করার জন্য।



আমার সব কথা শুনে কর্নেল মুখার্জি বললেন, বলেন কি! সত্যি সে কি আপনার কাছে টাকা চেয়েছে? আমি বলি, হ্যাঁ। এরপর কর্নেল মুখার্জি আমাকে বললেন, চলেন দেখি। তো উনি আমাকে নিয়ে বালুরঘাটে ঐ বিএসএফ ক্যাম্পে গেলেন। গিয়ে ঐ বিএসএফ কমান্ডারকে জিজ্ঞাসা করলেন, হোয়াই ডিড ইউ ডিমান্ডিং মানি ফ্রম দিজ। তখন ঐ কমান্ডার কুড নট রিপ্লাই। সে একদম চুপ করে থাকলো। কর্নেল মুখার্জি তাকে তখনই ক্লোজ করে অন্য জায়গায় ট্রান্সফার করে দিলেন। এরপর আমি টাকাগুলো স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়াতে জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করি। এ সব করে আমি আবার নওগাঁয় ব্যাক করলাম। যখন নওগাঁ পৌঁছলাম তখন দুপুর হয়ে গেছে।



সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর নাম : ড. সুকুমার বিশ্বাসসাক্ষাৎকার গ্রহণের তারিখ : অগাস্ট ১১, ২০০৫ ও অগাস্ট ৩১, ২০০৫ মূল প্রবন্ধ: প্রফাইল-বাংলা

Popular posts from this blog

“নওগাঁয় মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা”

নওগাঁয় পূর্বের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে,মেলায় অবৈধ ব্যাবসা

দূর্নীতি ছেয়ে আছে নওগাঁ বিটিআরএ