ঐতিহাসিক পাহাড়পুরের এক অজানা অধ্যায়

নবম শতাব্দীর শুরু থেকে কতিপয় বিদেশি রাজা আর দিম্বো নামের কৈবর্ত্য রাজা যে ইতিহাস মুছে দিতে শুরু করেন, ১২০০ শতাব্দীর সেন রাজবংশের শাসন শুরু হলে তা বাস্তব রূপ নেয়। ইতিহাস থেকে হারাতে শুরু করে পাল রাজবংশের বিশ্বখ্যাত সোমপুর বিহারের চিহ্ন। পাল রাজবংশের শাসন আমল থেকে বারবার আক্রমণ আর সেন রাজবংশের বাংলা শাসনামলে বাঙাল সেনাদের আগুন দিয়ে এই বিহার পুড়িয়ে দেয়ার চেষ্টার পর থেকে এখানকার ভিক্ষুরা চলে যেতে শুরু করেন। সেন রাজবংশের শাসনামলেই পরিত্যক্ত হয়ে যায় বিশ্বখ্যাত সোমপুর বিহার। যুগ যুগ ধরে এ বিহারের ওপর দিয়ে জমতে থাকা মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের ফলে বয়ে আসা ধুলা-বালিতে বিহারটি ঢাকা পড়ে রূপ নেয় এক বিশাল পাহাড়ের। ১৯২৩ থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত তত্কালীন ইংরেজ শাসকরা খনন করে ইতিহাসের সামনে আনেন নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলার অন্তর্গত পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার, যা আজ এক ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে পৃথিবী বিখ্যাত। এর আগে দিনে দিনে ধুলা আর মাটির স্তর পড়ে, যা সোমপুর বিহার বা পাহাড়পুর বিহার নামে পরিচিতি লাভ করেছিল। দেশ-বিদেশে হাজারো পর্যটকের কাছে এ পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার ঘিরে কৌতূহল অপরিসীম। হিমালয়ের সর্বদক্ষিনে অবস্থিত রাজা দ্বিতীয় রাম পালের অপূর্ব স্থাপত্য এই সোমপুর বিহার, যা কালক্রমে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার নামে পারিচিত লাভ করেছে। এর স্থাপত্য কৌশল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিশেষ করে মিয়ানমার ও জাভার স্থাপত্যকে প্রভাবিত করেছে। উত্তর-দক্ষিণে ৯২২ ফুট এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৯১৯ ফুটের এই বিহারের উত্তর সীমানার মাঝখানে রয়েছে প্রধান প্রবেশ পথ যা অত্যন্ত আকর্ষণীয় কারুকার্যের অলঙ্করণে শোভিত ছিল। ১৯৮২ সালে খনন কাজের সময় ১৬ ফুটত্র১৩.৬ ইঞ্চি আকারের নিম্ন আবাসের একটি কক্ষ খননকালে সেখানে পাওয়া গেছে একটি পোড়া মাটির মূর্তির মাথা, একটি তাম্র মুদ্রা এবং অন্য কিছু নিদর্শন যা গুপ্ত যুগের সন্ধান বহন করে। খননকালে প্রাপ্ত এ নিদর্শনগুলো পাহাড়পুর বিহারকে আবার জৈন বিহার বলে অনুমান করতে সাহায্য করে। এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রয়োজন আরও গভীর খনন, পর্যাপ্ত অনুসন্ধান, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সমীক্ষা । মূল বিহারের উন্মুক্ত আঙিনায় পাওয়া গেছে চতুষ্কোণ বিশিষ্ট সমআকারের ১৭৭টি কক্ষ। ধারণা করা হয়ে থাকে, এখানে বৌদ্ধভিক্ষুরা বসবাস করতেন। এছাড়া উন্মুক্ত আঙ্গিনায় এখানে সেখানে বেশ মাপ মতোই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে নিবেদন স্তপ কেন্দ্রীয় মন্দিরের অনুকরণে আরও ছোট ছোট মন্দির, কূপ, রান্নাঘর, ভোজনশালা ও অট্টালিকা । কেন্দ্রীয় মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়েছে ধাপে ধাপে উঁচু করে। এই কেন্দ্রীয় মন্দিরের প্রতিটি ধাপের দেয়ালে চারদিকে অলঙ্করণ করা আছে। পোড়ামাটির ফলক দিয়ে যাতে সভা পায় পশুপাখি, দেব-দেবী কাল্পনিক জীবজন্তু, তৈজসপত্র আর রমণ-রমণীর নানা ভঙ্গিমার মূর্তি। এর মধ্যে অনেক ফলক নষ্ট হয়ে বা চুরি হয়ে গেছে। ফাঁকা হয়ে গেছে মন্দিরের দক্ষিণ পাশের দেয়ালগুলো। ২০০০ সাল থেকে এ বিহারের নতুন আঙ্গিকে রক্ষণাবেক্ষনা শুরু হলে নষ্ট হয়ে যাওয়া বা চুরি হয়ে যাওয়া ফলকের অনুকরণে নতুন করে স্থানীয়ভাবে তৈরি পোড়ামাটির ফলক বসানো শুরু হয়েছে। বর্তমানে জমি অধিগ্রহণ করে এ বিহারে পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার কাজ চলছে। তবে এ কাজের গতি এতই ধীর যে, কতদিনে কাজ শেষ হবে তা অনুমান করা বেশ দুরূহ। সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে এখানে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তবে এখানে রাত যাপনের কোনো ব্যবস্থা নেই। দর্শনার্থীদের নওগাঁ থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরের এ অপূর্ব স্থাপত্য দেখতে নিজস্ব পরিবহনের সাহায্য নিতে হয়। তবে পূর্ব দিকের জাদুঘরের অনতিদূরে বেশ কয়েকটি খাবারের দোকান হওয়ায় খাবার সঙ্গে না নিলেও কোনো অসুবিধায় পড়তে হয় না । দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে নওগাঁ জেলা সদরে এসে পাহাড়পুর যাওয়া যায়, আবার বগুড়া ও জয়পুরহাট হয়েও পাহাড়পুর যাওয়া যায়। অনেক লেখকই তাদের লেখায় পাহাড়পুরকে জয়পুরহাট জেলার অন্তর্গত বলে উল্লেখ করেন যা মোটেও সঠিক নয়।

Popular posts from this blog

“নওগাঁয় মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা”

নওগাঁয় পূর্বের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে,মেলায় অবৈধ ব্যাবসা

দূর্নীতি ছেয়ে আছে নওগাঁ বিটিআরএ