নিচের পানির ওপর চাপ কমাতে পারে মরা খাল সংস্কার

দেশের দেড় হাজার খালের মধ্যে এক হাজারেরও বেশি মরে যাচ্ছে। যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে কৃষি ক্ষেত্রে। সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা বাড়ায় পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়াসহ পরিবেশগত নানা বিপর্যয়ও দেখা দিচ্ছে। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, মরা খালগুলো সংস্কার করা হলে এগুলোর পানি দিয়েই আরও সাড়ে ৭ লাখ একরেরও বেশি জমি সেচের আওতায় আনা সম্ভব। যা ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতাও অনেকটা কমাবে। সরকারি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে খালের সংখ্যা ১৪৭৯টি। এর মধ্যে খরা মৌসুমেও প্রয়োজন অনুপাতে পানি থাকে- এমন খালের সংখ্যা ১৩২টি। বড় নদী কিংবা শাখা নদী থেকে বিল, হাওড়, বাওড় প্রভৃতির সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী খাল রয়েছে ২৯৮টি। বাকি খালগুলোর মধ্যে কোনও কোনওটিতে খরা মৌসুমে মাঝে-মধ্যে পানি থাকে; আর অন্যগুলোতে খরা মৌসুমে পানি থাকে না। শুকনা মৌসুমে পানি না থাকা খালগুলোকে 'মরা খাল' (আনফিট) বলছেন সংশ্লিষ্টরা। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, মরা খালগুলো খনন বা সংস্কার করলে এগুলোর বিলুপ্তি যেমন ঠেকানো যাবে, তেমনি এগুলোর পানির ব্যবহার ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতাও অনেকটা কমাবে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) উপ-সচিব ড. মোল্লা আজফারুল হক সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ২০০৭ সালে সেচের আওতায় কৃষিজমি ছিল ৪৮ লাখ ৮২ হাজার ৮৭৯ হেক্টর। এর মধ্যে ভূ-উপরিস্থ পানি দিয়ে মাত্র ২০ শতাংশ কৃষি জমিতে সেচ দেওয়া হয়। সেচের বাকি ৮০ শতাংশই আসে ভূ-গর্ভস্থ পানি পাম্পের মাধ্যমে। তিনি বলেন, "এতে ভূগর্ভস্থ পানির চাপ বেড়ে যাচ্ছে দিনদিন। মরা খালগুলো সংস্কার হলে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহার আরও ১০ থেকে ১২ শতাংশ বাড়বে; যার মাধ্যমে সাড়ে ৭ লাখ একরেরও বেশি জমি সেচের আওতায় আনা সম্ভব।" মোল্লা আজফারুল হক বলেন, "বাংলাদেশে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের ৯০ শতাংশই হয় বর্ষাকালে। অল্প সময়ে অনেক বৃষ্টি হওয়ায় বেশিরভাগ পানি সাগরে চলে যায়। সে পানি ধরে রাখা সম্ভব হয় না। এদিকে পানির অভাবে গ্রীষ্ম মৌসুমে সেচ দেওয়া সম্ভব হয় না।" কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) মাইনর ইরিগেশন ইনফরমেশন সার্ভিস ইউনিট (মিশু)-এর সা¤প্রতিক জরিপে দেশে ১১৮১টি ছোট নদী-খাল-জলাশয় এবং ২৯৮টি সংযোগ খাল চিহ্নিত করা হয়েছে। মিশু'র প্রধান বিএডিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আবুল কাশেম মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "১৪৭৯টি খালের অধিকাংশ খালই মরে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও খালের চিহ্নটিও নেই। চৈত্র মাসে তো শুকিয়ে যায় সবখানে। প্রতি বছর খালগুলো সংস্কারের আওতায় এনে খনন কাজ চালালে খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।" তিনি জানান, গত দুই দশক ধরে ভূগর্ভস্থ পানির উত্তোলনের পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় মার্চ-এপ্রিলে পানির স্তর অগভীর নলকূপের উত্তোলন ক্ষমতার নিচে চলে যাচ্ছে এবং উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা দেখা দিচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক ও লোহার আধিক্য থাকায় ভূ-উপরিস্থ পানির উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও ব্যবহার বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে প্রকৌশলী আবুল কাশেম মিয়া মনে করেন। তিনি আরও বলেন, "ভূগর্ভ থেকে তোলা পানির ৫৭ শতাংশই অপচয় হয়। দক্ষ পাম্প চালনা ও যথাযথ যতœ নিলে এ অপচয় ১৭ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। এতে সেচ খরচ যেমন কমবে, তেমনি কৃষিখাতও উপকৃত হবে।" জরিপে দেখা যায়, খুবই শুকনো ও শুকনা এলাকায় প্রবাহিত ১৩২টি খালে শুকনা মৌসুমে পাম্প চালানো সম্ভব। যেগুলোতে স্বল্প আকারে সেচ কার্যক্রম আছে। এছাড়া ৫৮টি খাল প্রায় বিলুপ্ত। খাল সংস্কারে বিষয়ে মিশু'র প্রকৌশলী (কৃষি) খান ফয়সাল আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "খালগুলোকে সেচের আওতায় আনতে হলে ৯৩ লাখ ৮৬ হাজার ৩০৪ মিটার এলাকা সংস্কার প্রয়োজন। যাতে ৭ লাখ ৫৯ হাজার ৭২৭ একর জমি সেচের আওতায় আনা সম্ভব হবে। এতে উপকৃত হবে ১২ লাখেরও বেশি কৃষক।" খালগুলোর বিলুপ্তি দেশের মৎস্য সম্পদের ওপরও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদের (বিএআরসি) মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (ফিশারিজ) ড. কবির ইকরামুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপসহ নানা কারণে খালগুলো আজ বিপন্ন। এতে মাছের আবাসস্থল যেমন ধ্বংস হচ্ছে, তেমনি প্রজননও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।" মৎস্য সম্পদ রক্ষায় খাল সংস্কার জরুরি বলে মনে করেন কবির ইকরামুল হক। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরীতেই এক সময় ৪৩টি খাল ছিল। এরমধ্যে ১৭টির অস্তিত্ব এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কৃষি উপদেষ্টা ড. সি এস করিম সোমবার নদী বিষয়ক এক সেমিনারে বলেন, "নদী-খালে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত না করতে পারলে প্রতি বছরই নগরবাসী বন্যাকবলিত হবে এবং ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো দেশের অন্যশহরগুলোর জনজীবনও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।"
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

Popular posts from this blog

“নওগাঁয় মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা”

নওগাঁয় পূর্বের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে,মেলায় অবৈধ ব্যাবসা

দূর্নীতি ছেয়ে আছে নওগাঁ বিটিআরএ