গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পুনঃপ্রতিষ্ঠা

গণতন্ত্র শব্দটির তাৎপর্য সবার কাছে সমার্থক নয়। কারো কাছে গণতন্ত্র্র সম্ভবত দায়িত্বের সঙ্গে স্বাধীনভাবে নির্ধারণের অধিকার। অন্যদের কাছে গণতন্ত্র হলো কোন সংযম, দায়বদ্ধতা বা যথাযথ আইনী প্রক্রিয়া ছাড়া কাজ করার প্রয়োজনীয়তা ব্যতিরেকে অর্জিত ক্ষমতার ব্যবহার। মর্মার্থের এই ভিন্নতা আমাদের সবার জন্য রাজনীতি এবং রাজনৈতিক আচরণের পুনর্গঠনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে, যা স্বাভাবিকভাবে গণতন্ত্রের গতি-প্রকৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আজ আমরা আমাদের জাতীয় অস্তিত্বের এক গুরুত্বপূর্ণ মোহনায় দণ্ডায়মান। আমরা এমন সব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি যেগুলো মোকাবিলা ও অতিক্রম করতে হবে।আমাদের বর্তমান অবস্থার সঙ্গে চার্লস ডিকেন্সের দুনগরীর গল্পের উপমার কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ফরাসী বিপ্লবের সময় তিনি প্যারিসের কথা উল্লেখ করেছিলেন। আমি আজ উল্লেখ করছি ঢাকার কথা। আমি দেশের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের বিবর্তন ও উত্থান প্রক্রিয়া সম্পর্কে লেখা থেকে বেশ কিছুদিন নিবৃত্ত ছিলাম। আর তা করেছি সচেতনভাবেই। আমি একজন আগ্রহী পর্যবেক্ষক। আমি রাজনৈতিক জোট এবং দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রত্যক্ষ করেছি। আমি বছরের শুরুতে সূচিত ঝড়ের তীব্রতা প্রত্যক্ষ করেছি, যা গত কয়েক মাসে ক্রমে ক্রমে বেড়েছে। যাই হোক, আলামত দৃষ্ট হচ্ছে যে, একটা রূপান্তর ও সমাধানের পথ সমাগত।আমাদের মধ্যে কেউ কেউ দেশের অভ্যন্তরে বর্তমান শাসন প্রক্রিয়ার গতি-প্রকৃতি বিষয়ে উৎকণ্ঠা এবং দুশ্চিন্তা ব্যক্ত করেছেন। অন্যরা বর্তমান অবস্থায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। একজন বিশ্লেষক আমাকে অবহিত করেছেন যে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তার গণতান্ত্রিক মর্যাদা হারিয়েছে।তাঁর দুশ্চিন্তার কারণ যে, এ বছর নভেম্বরে বামাকো, মালিতে অনুষ্ঠেয় Community of Democracies (১২৬ সক্রিয় সদস্য এবং পর্যবেক্ষক সমন্বয়ে গঠিত গ্লোবাল গ্রুপ)-এর মন্ত্রী পর্যায়ের সভায় অংশ নিতে আমাদেরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। ২০০০ সালের পর প্রথমবারের মত, সম্ভবত দেশের বিদ্যমান অস্বচ্ছ এবং অস্বাভাবিক রাজনৈতিক অবস্থার কারণে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।আমি আমার বিশ্লেষক বন্ধুকে বলেছি যে, তিনি যেন এই মিটিং নিয়ে বেশি না ভাবেন। আমি দৃঢভাবে বিশ্বাস করি যে, আমরা ভবিষ্যতে এই গুরুত্বপূর্ণ গ্রুপের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হবো। আমরা সেখানে অংশ নেব, তৎপর্যপূর্ণ কার্যকর গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অসংখ্য স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল, সূক্ষ্ম কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর নির্বাচিত প্রতিনিধিগণের মাধ্যমে।আমরা একটা দায়িত্বশীল গণতন্ত্র চাই। অসংখ্য অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে যেগুলোর সমাধান খুঁজে বের করা দরকার। ইত্যবসরে আমাদের ইতিবাচক ও গঠনমূলক হওয়া উচিত। আমাদের উচিত নিজস্ব পথে আইনের যথায়থ প্রক্রিয়া অনুসারে বর্তমান প্রশাসনকে সঠিক সিদ্ধান্তে (গুরুত্বপূর্ণ, রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে দায়ের করা বিপজ্জনক অপরাধ সংক্রান্ত মামলার বিষয়ে) পৌঁছতে সাহায্য করা। বর্তমানে দেশ দ্বৈত শাসনের আদলে চলছে- আমাদের প্রধান উপদেষ্টা এই ধারণা বাতিল করে দিয়েছেন সম্প্রতি। এটাও পরিষ্কার করা হয়েছে যে জরুরী অবস্থা চালু থাকা সত্ত্বেও তিনি সেনাবাহিনীর কোন রাজনৈতিক ভূমিকা দেখছেন না। আমাদের সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বও স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, তারা ক্ষমতা গ্রহণে আগ্রহী নন। অধিকন্তু, এটাও সত্য যে, সেনাবাহিনী দুর্নীতি দমন, আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির উন্নতি, খাদ্য-সামগ্রী বাজারজাতকরণ ও বন্যায় ত্রাণসামগ্রী বিতরণের মত কার্যে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করে আসছে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে একটা সুন্দর অংশীদারিত্ব সৃষ্টি হয়েছে।কেউ কেউ এটাও বলেছেন যে, বর্তমান সরকার কিংবা সরকারের কতিপয় এজেন্সী রাজনীতির পুনর্গঠন, দেশের অভ্যন্তরে কতিপয় দলের নেতৃত্বের পরিবর্তন আনয়ন ও মিডিয়াকে ভীতি প্রদর্শনে অযাচিত আগ্রহ প্রদর্শন করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা বিষয়টা অস্বীকার করেছেন। আমরা আশা করব যে, তাঁর এই পুনঃনিশ্চয়তা প্রদান আগামীতে মিথ্যা প্রমাণ হবে না। যাই হোক, এটাও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বর্তমান বড় দুটি দলের মাঝে বিশৃংখলা বিরাজমান। আমি শুধু আশা করি যে, এই সুযোগে অধিকতর সংগঠিত চরম ডানপন্থী, যাদের নিজেদের মাঝেই চরম এক মৌলবাদী উপাদান রয়েছে, তারা যেন শক্তিশালী না হয়ে উঠে।ইত্যবসরে বর্তমানে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে উদ্ভাসিত হয়েছে মজার দৃশ্যপট। ঘরোয়া রাজনীতির উপর থেকে ঢাকা ও পাশ্ববর্তী এলাকায় নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে আশাবাদী যে, ঘরোয়া রাজনীতির ক্ষেত্রে দেশব্যাপী অন্ততপে বিভাগীয় পর্যায় পর্যন্ত যত শীঘ্রই সম্ভব তুলে নেওয়া হবে। এটা ভাল হবে। এটা অবশ্যই নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অধীনে প্রস্তাবিত সংস্কারের ক্ষেত্রেও (রাজনৈতিক দলগুলোর কাউন্সিল ও নির্বাহী কমিটির পর্যায়ে) বৃহত্তর পরিধিতে মতবিনিময় ত্বরান্বিত করবে। এটা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে প্রতিনিধি যারা বৃহত্তর ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রস্তাব রাখতে পারবেন, তাদের সঙ্গে চলমান আলোচনায় নির্বাচন কমিশনের হাতকেও শক্তিশালী করবে।মনে রাখা দরকার যে, আগামী নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য এবং স্বচ্ছ গণ্য করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে মীমাংসা করতে হবে। মিডিয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, কমিশন ৭২ সালের জনপ্রতিনিধি গণআদেশ সংশোধন ও নতুন বিধি প্রস্তাব করতে যাচ্ছে। তাদের সামনে কঠিন একটি বছর। তাছাড়া সংশোধিত ভোটার তালিকা এবং পরিচয়পত্র প্রস্তুত করা ছাড়াও কমিশনকে মৌলিক কাঠামোও চূড়ান্ত করতে হবে। এর অধীনে আগামীতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। রাজনৈতিক দলের শ্রমিক ও ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলা ও প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয় অনুমোদন সংক্রান্ত বিষয়ের মত সংবেদনশীল বিষয়েও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। আপাত দৃষ্টিতে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, নির্বাচন কমিশন ’৭২-এর গণপ্রতিনিধি গণআদেশ সংশোধিত আকারে খসড়া প্রস্তুত করেছে। এটা হবে গণপ্রতিনিধি গণঅধ্যাদেশ ২০০৭। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক একবার ঘোষিত হলে এই অধ্যাদেশ আইনের মর্যাদা পাবে এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতায় পরিণত হবে।প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশ হয়েছে এই বছরের নভেম্বরের মধ্যে দলগুলোর চলমান সংলাপ সমাপ্তির পর কমিশন প্রস্তাবিত খসড়া চূড়ান্ত করবে । আমি আশা করি যে, নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণের উপর কালো টাকা ও পেশীশক্তির প্রভাব অপসারণে উপযুক্ত বিধি-বিধান প্রয়োগে সমর্থ হবে। এর জন্য প্রত্যেক প্রার্থীর বিদ্যমান নিজের সম্পদ ও পরিবারের নিকটবর্তী সদস্যগণের সম্পদ বিবরণীর বিশদ প্রতিবেদন নির্বাচন কমিশন বরাবরে দাখিল করতে হবে। স্বীয় নির্বাচনী এলাকায় আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ডে প্রার্থীর সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্তও সন্নিবেশিত করতে হবে এবং তাঁর বিরুদ্ধে কখনও ফৌজদারী মামলা হয়েছে কিনা এবং তিনি দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন কিনা, তাও উল্লেখ করতে হবে । তিনি কোন ধরনের ঋণখেলাপী কিনা প্রতিবেদনে তার উল্লেখ থাকতে হবে। পরবর্তীতে বিশদ বিবরণী কমপিউটারে ওয়েব পেইজের মাধ্যমে তুলে ধরতে হবে, যাতে করে নির্বাচনী এলাকার প্রত্যেক ভোটার প্রয়োজনবোধে উক্ত ওয়েব পেইজের মাধ্যমে তথ্য পেতে পারেন। যদি পরবর্তীতে জানা যায় যে, প্রার্থী ভুল তথ্য প্রদান করেছেন কিংবা তথ্য গোপন করেছেন, তাহলে নির্বাচনে তাঁর প্রার্থিতা বাতিল করতে হবে। দিনের শেষে আমাদের কাছে এমন একটা কাঠামো থাকতে হবে যাতে করে চাঁদা বা অনুদানের ভিত্তিতে ধোঁয়ার মাঝে ব্যবসায়িগণের রাজনৈতিক অঙ্গনমুখী নৈশকালীন উড্ডয়ন ও জাতীয় সংসদ সদস্য হওয়া বন্ধ হয়। রাজনীতিকে অংশগ্রহণমূলক দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ অর্জনের রাস্তা হিসাবে দেখলে চলবে না। এমপি হওয়ার অর্থ আইন এবং দায়বদ্ধতার যথাযথ প্রক্রিয়ামুক্ত থাকার ছাড়পত্র নয়। কিছু রাজনৈতিক দল দেশব্যাপী যাদের উপস্থিতি খুবই কম, ইলেকশন কমিশনের আবশ্যকতাকে কঠোর অথবা অগণতান্ত্রিক বলে গণ্য করতে পারে। কিন্তু কোনক্রমেই তা সুশৃংখল পদ্ধতি প্রতিষ্ঠায় কমিশনকে বিরত রাখা সমীচীন নয়। উদাহরণস্বরূপ, সাম্প্রতিককালে একটি রাজনৈতিক দল ইলেকশন কমিশনকে বলে যে, অনিবন্ধিত দলের আগ্রহী প্রার্থীকে একটি নিবন্ধিত দলের মাধ্যমে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া উচিত। এটা অসম্ভব। যদি কেউ অংশ নিতে এতটাই আগ্রহী, তবে তিনি সব সময়ই একজন স্বাধীন প্রার্থী হিসাবে অংশ নিতে পারেন। নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর চলমান সংলাপে নিচের বিষয়গুলোর ব্যাপারে মনোযোগ দেওয়া উচিত : (ক) রাজনৈতিক দল কর্তৃক অনুদান গ্রহণ ও অন্যভাবে সম্পদ অর্জন সংক্রান্ত বিষয়ে স্থায়ী নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর প্রশ্ন এবং খরচ (যা আরো স্বচ্ছ ও বাৎসরিক নিরীক্ষাধীন করতে হবে)(খ) দল কর্তৃক নির্বাচনের অন্তত তিন মাস পূর্বে পরিষ্কার নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো প্রকাশ (ভবিষ্যৎ কৃষি উদ্যোগ, শক্তি, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ, স্বাস্থ্য পরিচর্যা, মানবাধিকারের সুরা, উচ্চতর শিক্ষা তথ্য প্রযুক্তির বিস্তার, যোগাযোগ ও পরিবহন খাত উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ, কঠোর পরিশ্রমী প্রবাসী কমিউনিটিকে সহায়তা প্রদান ও উৎপাদন ক্ষমতা এবং রফতানি ভিত্তি বহুমুখীকরণের প্রেক্ষিত নীতিসমূহ সম্পর্কিত)।এই ম্যানিফেস্টো মামুলি মন্তব্য-বর্জিত হতে হবে এবং জেলা বা জাতীয় পর্যায়ে অবস্থানের ভিত্তিতে প্রকৃত বিষয়ের প্রতি যথার্থ উত্তর প্রদানে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। বিশ্ব দৌড় প্রতিযোগিতায় আমাদের এক ধাপ এগিয়ে যেতে হবে ও আন্তর্জাতিক সমাজের মাঝে আমাদের সম্পর্কে বিশ্বাস সংরক্ষণ করতে হবে। যা আমাদের উপর তাদের আস্থার পরিবেশ বৃদ্ধি করবে। তাহলে তারা আমাদের দেশে আবার বিনিয়োগ করতে প্রস্তুত হবে।

তথ্য সুএ: বাংলাদেশ ইনফো

Popular posts from this blog

“নওগাঁয় মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা”

নওগাঁয় পূর্বের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে,মেলায় অবৈধ ব্যাবসা

দূর্নীতি ছেয়ে আছে নওগাঁ বিটিআরএ