প্রতি আট মাসে একটি নতুন রোগের ঝুঁকি "প্রতিরোধে দেশের প্রস্তুতি যথেষ্ট নয়"

দেশে এখন সোয়াইন ফ্লুর সংক্রমণ ঘটছে। এর আগে বার্ড ফ্লুর সংক্রমণ ছিল। সেই সংক্রমণ দেশের পোলট্রিশিল্পে বিপর্যয় ঘটায়। মানুষের মধ্যে পাখির রোগ ছড়াতে পারে—এ আশঙ্কা ছিল। সেই আশঙ্কা শেষ হয়নি। মাঝে নিপা ভাইরাসে মানুষের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছিলেন দেশি-বিদেশি বিজ্ঞানীরা। নিপা ভাইরাস ছড়ায় বাদুড়ে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রতি আট মাসে নতুন একটি রোগে মানুষের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর মানুষ নতুন নতুন সংক্রামক ব্যাধির ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দিন দিন ঝুঁকি বাড়ছে। গবেষকেরা বলছেন, মনুষ্য প্রজাতি গত ২৫ বছরে ৩৫টি নতুন সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগরায়ণ, মানুষের অতিমাত্রায় বিশ্ব ভ্রমণের কারণে সংক্রামক ব্যাধি দ্রুত পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে।
চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিম্যাল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নীতীশ দেবনাথ বলেন, মেক্সিকোতে সোয়াইন ফ্লুর সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে সারা পৃথিবীতে তা ছড়িয়ে পড়ল। মেক্সিকো থেকে বাংলাদেশের দূরত্ব ১৪ হাজার মাইল, কিন্তু সোয়াইন ফ্লুর সংক্রমণে বাংলাদেশে মানুষের মারা যেতে ১৪ সপ্তাহ সময় লাগেনি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেশি।
ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মো. নজরুল ইসলাম বলেন, সোয়াইন ফ্লুর ঘটনায় স্পষ্ট হয়েছে যে হঠাত্ সংক্রমণ মোকাবিলায় দেশ প্রস্তুত নয়। সোয়াইন ফ্লুর ভাইরাস যদি ব্যাপক প্রাণঘাতী হতো (ভেরুলেন্ট), তাহলে দেশে মৃতের সংখ্যা অনেক বেশি হতো।
নতুন রোগ আসছে: রোগতত্ত্ববিদেরা বলছেন, পৃথিবীর মানুষ নতুন নতুন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মার্ক উলহাউস ২৫ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে বলেছেন, এই সময়ে মানুষ ৩৮টি নতুন রোগে আক্রান্ত হয়ছে। এই রোগ আগে মানুষের মধ্যে ছিল না। এসব রোগের ৭৫ শতাংশ এসেছে জীবজন্তু ও পশু-পাখি থেকে।
আমেরিকান ভেটেরিনারি মেডিকেল কলেজ তাদের প্রকাশনায় বলেছে, প্রতি আট মাসে পৃথিবীতে একটি করে নতুন রোগের আবির্ভাব ঘটতে পারে এবং জীবজন্তু ও পশু-পাখির রোগ মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি খুবই বাস্তব।
নীতীশ দেবনাথ বলেন, বন উজাড় বা অন্য আরও অনেক কারণে জীবজন্তু ও পশু-পাখির আবাসন নষ্ট হওয়ায় নতুন রোগ আসছে। আবার বাণিজ্যিক কৃষিখামারের কারণেও নতুন রোগের উদ্ভব হচ্ছে। এগুলোর কিছু ঢুকে পড়ছে মানুষ্য প্রজাতিতে।
সংক্রামক ব্যাধির বিস্তার: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সংক্রামক ব্যাধির বিস্তার নিয়ে পর্যালোচনা করেছে (গ্লোবালাইজেশন অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস: এ রিভিউ অব দ্য লিংকেজ)। তাতে দেখা যায়, ১৯৯৫ সাল থেকে ৩০টি নতুন ও পুরোনো রোগ ‘নতুনভাবে’ আবির্ভূত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন, বড় বড় বাঁধ নির্মাণ, বন উজাড় হওয়া, বিস্তীর্ণ ভূমি ন্যাড়া হওয়া—এসব কারণে (সিলেকটিভ অ্যাডভান্টেজ) রোগের অবির্ভাবে হচ্ছে।
নীতীশ দেবনাথ বলেন, ঘনবসতি ও বিশ্বব্যাপী মানুষের চলাচল বৃদ্ধি সংক্রমণ বিস্তারে সহায়ক হয়েছে। জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিভাগের হিসাবের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৬৫০ কোটি ছাড়িয়ে যায়। আর ২০০৭ সালে গ্রামের চেয়ে শহরের জনসংখ্যা বেশি হয়ে যায়। তিনি বলেন, বর্তমানে বিমানে বছরে প্রায় ২০০ কোটি মানুষ এক শহর থেকে অন্য শহর, এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত করে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি যেকোনো সংক্রামক ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সহায়ক।
করণীয়: নজরুল ইসলাম বলেন, সম্ভাব্য সব রকম পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকাটা জরুরি। তিনি দুটি বিষয়ের ওপর বেশি জোর দেন। প্রথমত ব্যবস্থাপনা; এবং চিকিত্সকসহ সব ধরনের স্বাস্থ্যকর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া। সোয়াইন ফ্লুর সময় যাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের ভবিষ্যতে কাজে লাগাতে হবে। দ্বিতীয়ত, মানুষকে দ্রুত সচেতন করার জন্য প্রস্তুত থাকা। তিনি বলেন, সোয়াইন ফ্লু বিস্তারের প্রথম দিকে সরকার বলেছিল, আন্তর্জাতিক বিমান ও স্থলবন্দরে বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সেই ব্যবস্থায় অনেক ত্রুটির তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। ভবিষ্যতে যেন এমন না হয়, সেটা এখনই নিশ্চিত করতে হবে।
আন্তর্জাতিকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে এমন রোগে প্রতিহত, প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে ২০০৫ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি (২০০৫) গৃহীত হয় এবং ২০০৭ সালের জুন থেকে তা কার্যকর হয়। বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই বিধি বাস্তবায়ন করার জন্য তাতে স্বাক্ষর করেছে। বিধি মোতাবেক সদস্য দেশগুলো অবকাঠামো উন্নয়ন, জনবল প্রশিক্ষণ ও আইন তৈরির ক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ নিয়েছে তা ২০১২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে জানাতে হবে।
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি ২০০৫ কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে তা মূল্যায়ন করেছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের প্রবেশদ্বারগুলোতে (পয়েন্ট অব এন্ট্রি) রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে কোনো চুক্তি নেই। দেশে ইনফ্লুয়েঞ্জা, পোলিও ও নিপাহ ভাইরাসের প্রকোপ নিরূপণের জন্য নির্দেশিকা ও জাতীয় কৌশলপত্র আছে। রোগের উপাত্ত ব্যবস্থাপনাপদ্ধতি কেন্দ্রীয় পর্যায়ে যথেষ্ট ভালো, কিন্তু জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে দুর্বল। এসব ক্ষেত্রে অর্থ বরাদ্দ ও প্রশিক্ষিত জনবল কম।

সূত্র: প্রথম আলো

Popular posts from this blog

“নওগাঁয় মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা”

নওগাঁয় পূর্বের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে,মেলায় অবৈধ ব্যাবসা

দূর্নীতি ছেয়ে আছে নওগাঁ বিটিআরএ